পাঁচ বছরের গবেষণার ফল এলো
লেখা ও ছবি : রাকিবুল হাসান, প্রতিনিধি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের গবেষক-অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান খান রবিন। নিউজিল্যান্ডের ম্যাসি ইউনিভার্সিটি থেকে এই অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটি ২০১১ সালে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় সুনচুন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট-ডক্টরেট গবেষণা সম্পন্ন করেছেন।
তিনি সরিষা, ধান, গম ও মিষ্টি আলুর উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণা করছেন।
অধ্যাপক ড. রবিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮, ’২০ এবং ’২২ সালে ‘সেরা প্রকাশনা অ্যাওয়ার্ড’ জয়ী।
২০২২ সালের বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি রিসাচ সিস্টেমের (বাউরস) বার্ষিক গবেষণা অগ্রগতি কর্মশালা-২০২২’র সেরা ‘প্রবন্ধ উপস্থাপক’ অ্যাওয়ার্ড জয় করেছেন তিনি।
তার নেতৃত্বে ‘ছত্রাকজনিত অল্টারনারিয়া ব্লাইট ডিজিজ’ প্রতিরোধী ও উচ্চফলনশীল পাঁচটি সরিষার জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও ছাত্র, ছাত্রীরা।
তারা জানিয়েছেন, আগাম ও স্বল্প জীবনকালধর্মী আমন ধান চাষের পর একই জমিতে আমাদের উদ্ভাবিত এই সরিষার জাতগুলো কৃষকরা সারা দেশে চাষ করতে পারবেন।
দীর্ঘ পাঁচটি বছরের গবেষণা করে এই অসাধারণ সাফল্য লাভ করেছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
গর্বের সঙ্গে আরো বলেছেন, প্রকল্পটিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত সরিষার এই নতুন জাতগুলো হলো-‘বাউ সরিষা-৪’, ‘বাউ সরিষা-৫’, ‘বাউ সরিষা-৬’, বাউ সরিষা-৭ ও ‘বাউ সরিষা-৮’।
কৌলিতত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান খান রবিন তার ছাত্র ও প্রতিবেদকদের এরপর জানিয়েছেন, ‘আমাদের উদ্ভাবিত পাঁচটি জাতের সরিষার গড় ফলন, হেক্টর প্রতি ২ দশমিক ৫ টন। বাংলাদেশে প্রচলিত অন্যান্য জাতের সরিষাগুলোর তুলনায় আবাদে ফলন ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ বেশি হবে। এই জাতগুলোর প্রতিটিই সারাদেশে চাষের উপযোগী। সরিষা গাছগুলোর জীবনকাল ৯০ থেকে ৯৫ দিন। কৃষকরা সরিষাগুলো চাষ করে প্রচলিত জাতের তুলনায় প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ আয় করতে পারবেন।’
আজ ২৭ জুন, সোমবার সকাল ১১ টায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তথ্যগুলো প্রদান করেছেন গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান খান রবিন।
ড. রবিন আরো বলেছেন, “দেশে সরিষা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো, নানা রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো, ‘অল্টারনারিয়া ব্লাইট ডিজিজ’। এটি আসলে ছত্রাকজনিত একটি রোগ। রোগটিই এককভাবে তেল বীজের ফলন ৩০-৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এমনকি কোনো, কোনো ক্ষেত্রে জমির শতভাগ ফসল নষ্টও করে। আমাদের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদালয়ের গবেষণার মাধ্যমে নতুন উদ্ভাবিত সরিষা জাতগুলো অল্টারনারিয়া ব্লাইট রোগে উচ্চমাত্রায় সহনশীল, প্রায় ৯৯ শতাংশ প্রতিরোধী।”
তিনি এরপর বলেছেন, ‘আগাম ও স্বল্প জীবনকালের আমন ধান চাষের পর একই জমিতে সরিষার জাতগুলো কৃষকরা চাষ করতে পারবেন।’
তারা জানিয়েছেন, প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে শুরু করলেও গত তিন বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রকল্পটির গবেষণা চলমান ছিল। আমাদের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান গবেষক হিসেবে কাজ করছেন।’
সরিষার উপকারিতা সম্পর্কে প্রধান গবেষক বলেছেন, ‘সরিষার তেল হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এই ফসলের প্রাকৃতিক তেলে মনো-আনসেচুরেটেড ও পলি-আনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড আছে। ফলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় সেবনে। ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের একটি আদর্শ অনুপাত (২.৫ : ১) থাকা এই তেল স্বাস্থ্যের জন্য অতি উপকারী।’
তিনি জানান, “আমাদের উদ্ভাবিত জাত পাঁচটি ‘ব্রাসিকা জুনসিয়া’ প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত। এই জাতগুলোর দানা অতিরিক্ত আদ্র্র্রতায়ও ১শ দিনের মধ্যে পরিপক্ব হতে সক্ষম।”
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে এখন প্রায় ০.৩ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সরিষা ফসল চাষ হয়। পুষ্টিগুণ, স্বাদ ও ঝাঁঝময় অনন্য এই ফসল রসনা বিলাসী। সরিষার বীজে জাতভেদে ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ তেল থাকে। বাংলাদেশে তেলের উৎপাদন চাহিদার মোট চাহিদার ১৫-২০ শতাংশ পূরণ করছে এই অর্থকরী ফসল। ভোজ্য তেল আমদানিতে বাংলাদেশকে প্রতিবছর ২ হাজার ১’শ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয় বলে সরিষা তেলের চাষাবাদ আরো বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সরিষা জাতগুলো আবাদের মাধ্যমে দেশে ভোজ্যতেলের সংকট অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানান প্রধান গবেষক ড. রবিন।
ছবি : ১. ছাত্র গবেষকদের সঙ্গে মাঠ গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের গবেষক-অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান খান রবিন।
২. সাফল্য লাভ করা সরিষা খেতে অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান খান রবিন ও তার গবেষক দল।
৩. গবেষণা মাঠ জরিপ কার্যক্রমে তারা।
৪. নিজে কাজ করছেন জমিতে।
৫. বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও এই প্রকেল্পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসানের সঙ্গে।
ওএস।