মাড়াই করা ধানও শুকাতে পারছেন না হাওরের কৃষকেরা
হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলার লাখও মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন বোরো ধান। বোরো ফসল দিয়েই সারা বছরের স্বপ্ন বুনেন হাওরপাড়ের কৃষকেরা। এবার ফসলও ভালো হয়েছিল বেশ। কিন্তু প্রথম দফায় ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওরের বাধ ভেঙে তলিয়ে ধান যায়। গত ৩০ মার্চ মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ জেলার নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। এ অবস্থা অব্যাহত থাকার কারণে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার নজরখালী বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরের ফসল ডুবে যাওয়াসহ একের পর এক ছোট-বড় কয়েকটি হাওরের ফসলহানি ঘটেছে। বাঁধ ভেঙে সর্বনাশ হয়েছে ২৩ হাজার কৃষক পরিবারের।
প্রথমে হাওর জুড়ে পানি, তাড়াহুড়া করেই কাঁচা ও আধা-পাকা ধান কেটে ঘরে তুলেন কৃষকরা। পরে আবারও শুরু হয় ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল। টানা বৃষ্টিপাতে রোদের দেখা না পাওয়ায় মাড়াই করা ধান নিয়ে বিপাকে পড়েন হাওর এলাকার কৃষকরা। ভেজা ধান শুকাতে না পারায় ধানে চারা গজানোর কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছেন হাজারো কৃষক।
তাহিরপুর উপজেলার মনসুর আলম এবার ৩০ বিঘা জমিতে বোরোধান চাষ করেছিলেন। ফলন বাম্পার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু ধান কেটে মাড়াই দিয়েও বিপাকে পড়েছেন তিনি। শুকাতে না পারায় তার ১০০ মণ ভেজা ধানে গজিয়ে গেছে চারা। ধান শুকাতে না পারায় এভাবে সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলার শতাধিক টন ধানে চারা গাজানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক কৃষক। যদিও ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন ঢলের পানিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হতে পারে। কৃষি বিভাগ ক্ষয়ক্ষতির তথ্য গোপন করছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
শুধু তাই নয় এরই মধ্যে আরও বড় বিপত্তিতে পড়েছেন কৃষকরা। সুনামগঞ্জে গত কিছুদিন থেকে টানা ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে হাওর ও নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় প্রবেশ করছে সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে। আর সেখানেই বিপত্তিতে পড়েছেন হাওরের মানুষ। ঢলের পানিতে ভেসে গেছে হাওরের উঁচু এলাকার মাড়াই করা ধানও। এ ছাড়া বন্যার পানির কারণে খড় পচন ধরায় গবাদিপশুর খাবার নিয়েও শঙ্কায় তারা।
সরজমিনে দেখা যায়, নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ঘরের মধ্যে ডুকে পড়েছে পানি। এ ছাড়া নিম্নাঞ্চল হওয়ায় কাঁচা রাস্তা পানিতে ভেসে গিয়েছে। তাই এখন যোগাযোগের মাধ্যম হয়েছে নৌকা আর সেই নৌকা করে ধান নিয়ে রাস্তায় রোদে শুকাচ্ছেন তারা। ধানে চারা গজানোর ফলে এসব ধান থেকে চাল পাওয়া যাবে না বলে জানান কৃষকরা। কেউ কেউ উপায় না পেয়ে নৌকায় ধান ভিজিয়ে রেখে দিয়েছেন। বৃষ্টি থামলেই ধান সড়কে মেলে দিচ্ছেন আবার বৃষ্টি শুরু হলে তাড়াহুড়ো করে ঘরে ধান তুলছেন। তবুও বাঁচাতে পারছেন না স্বপ্নের সোনালী ধান। অন্যদিকে যাদের ধান আর ঘর দুটোই পানিতে গিয়েছে তারা পড়েছেন মহা বিপদে। কী করবেন সামনের দিনগুলিতে সেটি নিয়েই বেশি চিন্তিত হাওর এলাকার মানুষ।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লালপুর এলাকা বাসিন্দা আরমান আলী বলেন, ‘১০ কেয়ার জমিত ধান চাষ করছিলাম, সব নিছে পানি, মাত্র দুই কেয়ার তুলতে পারছিলাম।এখন ধানগুলাও ভেজা, তিন দিন ধরি ধানগুলা পানিত ভিজেছে কিছু করার ছিল না। আজকে রোদ উঠেছে তাই রাস্তার নিয়ে শুকাচ্ছি। এই ধান বেচতাম কিলান আর বেচলে এই টাকা দিয়া আমার সংসার কয়দিনইবা চলব।’
তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘ধানের দাম সরকার ঠিক করিয়া দিলেও আমরা এই দামে ধান দিতে পারি না আর যে দামে ধান দেই এই দামে ১ মাস ভালা করি খাওয়া যাইত না।’
হাওরপাড়ের আরেকজন তাজউদ্দিন বলেন, ‘আমরার ধানটা বৈশাখ মাসের ধান কিন্তু পাকা ধান মাঠ আছিন, এক রাইতের মেঘে (বৃষ্টি) পাকা ধান সব নষ্ট করি দিসে। মন মেজাজ খুব খারাপ ভাই এখন। আমরা নিম্নাঞ্চলের কৃষকদের এতো দুঃখ দেখব টা কে? গরিবের কেউ নাই।’
ছাতক উপজেলার আব্দুল ছাত্তার বলেন, বন্যায় আমাদের শুকনা ধান নষ্ট হয়ে গেছে। তা আর কোনোভাবেই কাজে লাগানো যাবে না। আর সঙ্গে আমার গরুর খাবার খড়ও নষ্ট হয়ে গেছে। সামনে কোরবানির ঈদ গরুরে কী খাওয়াব, আর কীভাবে বিক্রি করব। হাওরেও পানি, খাবার তো কোথাও নেই। ঘরে ১৪টা গরু আছে তাদের খাবার নিয়ে খুবই চিন্তায় আছি।
বাজারে পণ্যের দামে দিশেহারা হাওরের ক্ষতিগ্রস্তরা, একে ধানে ক্ষতি অন্যদিকে হাওরে পানি আবার বাজারে পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়েছেন তারা। চাল ঘরে থাকলেও তেল, নুন আর সবজির কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন হাওরপাড়ের কৃষকরা।
আব্দুল সামাদ নামে এক কৃষক বলেন, ‘আমার ধান করার জমি নাই। মানুষের লগে ধান কাটিয়া কিছু ধান পাইছলাম ইকান থাকি চাল পাইছি কিন্তু খালি চাল দিয়া কিতা করতাম। তেল নুন সবজিওতো লাগে। তেলের দাম ২০০ টাকা ইটা গরিব মারার নতুন ফন্দি। বাজারে যাইতে ভয় লাগে এর মাঝে পানি আইছে ছোট ছেলেটায় জাল নিয়া গেছে হাওর মাছ মারতো হে, মাছ আনলে তো গিয়া ভাত খাইতাম।’
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি অফিসের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ঢলের কারণে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এখনো পুরোপুরি নিরুপণ হয়নি। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। বৃষ্টিতে হাওরে পাকা ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। আজকে পর্যন্ত ৬৫০ হেক্টর জমির পাকা ধান নিমজ্জিত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। জেলার বেশিরভাগ জায়গায় পানি থাকায় কৃষকরা পাকা মাড়াই ধানগুলোও শুকাতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, সব নদীর পানি এখনও বিপদসীমার উপর দিয়েই বইছে। যদি পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকে তাহলে পানি আরও বাড়তে পারে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে তাদের সহায়তা প্রদান করা হবে। বন্যার্ত এলাকায় ত্রাণ সহযোগিতা হিসেবে জেলায় ৩০ মেট্রিকটন জিআর চাল ও নগদ সাড়ে ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বন্যাকবলিকতদের মাঝে ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
এসএন