বিদেশিদের দাপটে ঘরোয়া ফুটবলে গোল খরায় দেশি স্ট্রাইকাররা
বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিনের স্বপ্ন নিজ হাতে সাফ ফুটবলের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি তিনি লাল সবুজের প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেবেন। তিনি যে আবার সাফেরও সভাপতি। এ দায়িত্ব তিনি পালন করে আসছেন সেই ২০০৯ সাল থেকে। কিন্তু এতদিন তার এ স্বপ্ন বাংলাদেশের ফুটবলাররা একটিবারের জন্যও পূরণ করতে পারেননি। এমনকি স্বপ্ন পূরণের ধারে কাছেও যেতে পারেননি। গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছে। এতই করুণ বাংলাদেশের ফুটবলের অবস্থা!
ফুটবল গোলের খেলা। জিততে হলে গোল করতে হবে। যতোই ভালো খেলা হোক না কেন, গোল করতে না পারলে, জিততে না পারলে সেই ভালো খেলার কোনো মূল্যই থাকে না। আর এখানেই পা পিছলে পড়েছে বাংলাদেশের জাতীয় দল। গোল যেন তাদের কাছে হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ। ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সালের মার্চ অবদি বাংলাদেশ দল ১৮ ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছে মাত্র তিনটিতে। তিন জাতি আসরে কিরগিজস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে ১-০ গোলে, শ্র্রীলঙ্কায় চার জাতির আসরে ২-১ গোলে মালদ্বীপকে এবং সাফে শ্রীলঙ্কাকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। বাকি ১৬ ম্যাচের ছয়টিতে ড্র করে হেরেছে ১০টিতে। এ ১৮ ম্যাচে বাংলাদেশ গোল করেছে মাত্র তেরটি। হজম করেছে ২৭টি।
এ যে আর্ন্তজাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের ব্যর্থতা, তা এ গোল করতে না পারার কারণে। আর গোল স্ট্রাইকাররা করবেনই বা কী করে? ঘরোয়া ফুটবলেইতো তারা গোলই করতে পারছেন না! সর্বত্রই বিদেশি ফুটবলারদের জয়-জয়কার। গোলের ছড়াছছড়ি। এবারের প্রিমিয়ার লিগের প্রথম পর্বের দিকে দৃষ্টি ফেরালে বিষয়টি আরও করুণভাবে ফুটে উঠে। লিগে গোল হয়েছে ১৯৫টি। সর্বোচ্চ গোলদাতার আশে-পাশেও নেই বাংলাদেশের কোনো স্ট্রাইকার। সর্বোচ্চ ১৩ গোল করেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর নাইজেরিয়ার স্ট্রাইকার পিটার এভিমুবুয়ে। দ্বিতীয় স্থানে আছেন ১০ গোল করে বসুন্ধরা কিংসের ব্রাজিলের স্ট্রাইকার রবসন। ৭ গোল করে আছে চারজনের। চারজনই বিদেশি। আবাহনীর দোরিয়েলতন, শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের সোলোমন কিং, ম্যাথু চিনেদো, মোহামেডানের সোলাইমানে দিয়াবাতও। ৬ গোল করে চারে আছেন সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার এমেকা ওগবগ ও রহমতগঞ্জের সানডে চিজোবা। ৫টি করে গোলে করেছেন চারজন ফুটবলার। তারাও বিদেশি। বসুন্ধরা কিংসের নাইজেরিয়ার এলিটা কিংসলে। তিনি অবশ্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। বাকিরা হলেন- আবাহনীর কোস্টারিকার কলিন্দ্রেস,রহমতগঞ্জের ঘানার ফিলিপ আজহা ও সাইফ স্পোর্টিংয়ের নাইজেরিয়ার এমফুন উদো। এরপর ৪ গোল করেছেন চারজন ফুটবলার। এখানে এসে পাওয়া গেছে একজন বাংলাদেশি স্ট্রাইকারকে। তিনি হলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আমিনুর রহমান সজিব। তার সঙ্গে আছেন বাংলাদেশ পুলিশের আফগানিস্তানের ফরোয়ার্ড আনোয়ার শরিফি,স্বাধীনতা সংঘের নেদো তুর্কোনেভিচ ও শেখ রাসেলের কিরগিজস্তানের আইজার আকমাতভ। এরপর শুধুই বাংলাদেশি ফুটবলারদের ছড়াছড়ি। ৩ গোল করে আছে আবাহনীর নাবিব নেওয়াজ জীবন, শেখ রাসেলের মোহাম্মদ জুয়েল,সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের সাজ্জাদ হোসেন শাকিল ও ও উত্তরা বারিধারার সুজন বিশ্বাস। এদের সঙ্গে আছেন আফগানিস্তানের ওমিদ পপালজাই ও শেখ জামালের জাম্বিয়ার সোলায়মান সিল্লা।
দেশি ফুটবলারদের পায়ে যখন গোলের খরা। সর্বোচ্চ গোল ৪টি, সেখানে হ্যাটট্রিক কী আর আশা করা যায়? তাই বাংলাদেশি কোনো ফুটবলারের নামে পাশে নেই কোনো হ্যাটট্রিক। অথচ হ্যাটট্রিক হয়েছে ৬টি। যেখানে একজনই করেছেন ২টি। তিনি হলেন চট্টগ্রাম আবাহনীর পিটার এভিমুবুয়ে। সাইফ স্পোর্টিং ও উত্তরা বারিধারার বিপক্ষে তিনি হ্যাটট্রিক দুইটি করেন। তবে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন আবাহনীর দোরিয়েলতন। প্রতিপক্ষ ছিল রহমতগঞ্জ। অপর ৩টি হ্যাটট্রিক করেন সাইফ স্পোর্টিংয়ের এমেকা ওগবগে, বাংলাদেশ পুলিশের আনোয়ার শরিফি ও শেখ জামালের ম্যাথু চিনেদো। এ তিনটি হ্যাটট্রিকই ছিল স্বাধীনতা সঙ্গের বিপক্ষে।
সাফল্য পেতে মরিয়া ক্লাবগুলো বিদেশি স্ট্রাইকার নিয়ে আসার কারণে পিছিয়ে পড়ছেন দেশি স্ট্রাইকাররা। আর এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় দলের খেলায়। এর থেকে আপাতত উত্তোরণের কোনো উপায় দেখছেন না বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন। ঢাকাপ্রকাশকে তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের করার কিছুই নেই। আমাদের হাত-পা বাঁধা। ক্লাবগুলো যেকোনো উপায়ে তাদের সাকসেস চায়। সাকসেসের জন্য তারা স্ট্রাইকার নিয়ে আসছে। তাদের এনে ক্লাবগুলো সাকসেসও হচ্ছে।’ নিজের খেলোয়াড়ী জীবনের একটা উদাহরণ দিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘ আমি ১৯৭০ সালে ১৬ বছর বয়সে মোহামেডান ক্লাব চলে যাই। তখন অনেকেই আমাকে যেতে নিষেধ করেছিলেন। আমি গেলে সাইড লাইনে বসে থাকব। খেলার সুযোগ পাব না। মোাহমেডানে তখন অনেক নামী-দামী খেলোয়াড়রা ছিলেন। তারপরও আমি গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর প্রথম ৮টি ম্যাচে আমি খেলার সুযোগ পাইনি। নবম ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে আমি ২ গোল করি। পরে আমি সব ম্যাচ খেলে ১৮ গোল করেছিলাম। ঘটনাটা বললাম এজন্যই যে আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছিলাম। তাই এখন ক্লাব ফুটবলের যে পরিস্থিতি, তাতে দেশি খেলোয়াড়দের নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে নিজেদের। এ ছাড়া করার আর কিছু নেই।’ তিনি স্পেনের লা লিগারও উদাহরণ দিয়ে বলেন, স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুইটি ক্লাব বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদ। স্পেন যে বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো, তখন এ দুই ক্লাবের স্ট্রাইকাররা ছিলেন সব বিদেশি। বার্সেলোনায় মেসি-সুয়ারেজ, রিয়াল মাদ্রিদ রোনালদো-করিম বেনজামা। তারপরও তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছিল। কারণ তাদের দেশি ফুটবলারার নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। এখন আমাদের ফুটবলারদেরও এ কাজটি করে দেখাতে হবে।
রবিবার থেকে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্বের খেলা। এখানেও পরিবর্তনের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে? কারণ প্রথম দিন খেলা হয়েছে দুইটি। দুইটি ম্যাচেই ফলাফল ছিল ২-০ করে। আর এ চারটি গোলই করেছেন বিদেশি ফুটবলাররা।
এমপি/এসএন