স্মৃতির আয়নায় সামি
বাংলার ক্রিকেট আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ল আরেকটি নক্ষত্র। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা পেস বোলার সামিউর রহমান সামি দীর্ঘদিন ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে আজ মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) সকালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আজ আকাশচুম্বি। টাকার ছড়াছড়ি। অঢেল সুযোগ সুবিধা। বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ যে পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে আছে এই রকম সামিউল রহমান সামিদের অনেক ঘাম ঝরানো পরিশ্রম। তারা যখন খেলতেন, তখন টাকার ঝনঝানিও ছিল না। ছিল না এ রকম বহুবিধ সুযোগ-সুবিধাও। বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলা কোনো বিষয় নয়, চাইলেই খেলতে পারে; কিন্তু একটা সময় তা ছিল চির আরাধ্য। এশিয়া কাপই ছিল একমাত্র ভরসার জায়গা। তাইতো সামিউর রহমান সামি তার গোটা ক্যরিয়ারে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন মাত্র দুইটি। তাও এশিয়া কাপে এবং সেই দুইটি ম্যাচই ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সামি দুইটি ম্যাচেই বাংলাদেশের হয়ে বাঁহাতি পেসার গোলাম নওশের প্রিন্সের সঙ্গে বোালিং সূচনা করেছিলেন। দুইটি ম্যাচেই বাংলাদেশ হেরেছিল। প্রথম ম্যাচ ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে, পরের ম্যাচ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ শ্রীলঙ্কার মুরাতোয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ আগে ব্যাট করে মাত্র ৯৮ রান করেছিল। পাকিস্তান জিতেছিল ৭ উইকেটে। সামি সেই ম্যাচে ব্যাট করতে নেমেছিলেন সবার শেষে। ২ বল খেলে কোনো রান করতে পারেননি। গুগলি মাস্টার আব্দুল কাদিরে বলে জুলকারনাইনের হাতে স্ট্যাম্পিং হয়েছিলেন। পরে বল হাতে অবশ্য নজর কেড়েছিলেন মুদাসসর নজর, মহসিন খান, রমিজ রাজা, জাভেদ মিয়ানদাদের ব্যাটিং লাইনের বিপক্ষে ৭ ওভারে ১টি মেডেন নিয়ে ১৫ রান দিয়ে। যদিও কোনো উইকেট পাননি। ম্যাচে তার বোলিংই ছিল সবচয়ে ইকোনমিক।
২ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ক্যান্ডিতে দ্বিতীয় ম্যাচেও বাংলাদেশ হেরেছিল ৭ উইকেটে। এবারও আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ অবশ্য অলআউট হয়নি। ৮ উইকেটে করেছিল ১৩১ রান। এই ম্যাচে সামি আর সবার শেষে ব্যাট করতে নামেননি। ৯ নম্বারে নেমে ৫ বল খেলে ৪ রান করে আউট হয়েছিলেন আমালিনের বলে ডিয়াসের হাতে ধরা পড়ে। পর বল হাতে যথারীতি প্রিন্সের সঙ্গে বোলিংয়ের উদ্বোধন। এবার তিনি বোলিং করেন মাত্র ৩ ওভার। রান দেন ১৫ পাননি কোনো উইকেট। এই হলো সামির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা জাতীয় দলের হয়ে সামিউর রহমান সামি হয়তো তেমন কোনো কিছুই করে যেতে পারেননি। বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের সেরা একাদশের একজন হিসেবে আজীবন থেকে যাবেন ইতিহাসের পাতায়।
সামিউল রহমান সামি আন্তর্জাতিক ম্যাচ দুইটি খেললেও জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন আরও অনেক ম্যাচ। যেখানে উল্লেখযোগ্য ছিল আইসিসি ট্রফি খেলা। সামিউর রহমান সামির বড় ভাই প্রখ্যাত ক্রিকেটার ব্যাটসম্যান ইউসুফ রহমান বাবু। দুই ভাই এক সঙ্গে খেলেছেন আইসিসি ট্রফিতে। এই আসরে ইউসুফ রহমান বাবুর (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) আছে একটি সেঞ্চুরিও। ৭০-৮০ দশকে দুই ভাই-ই দাপটের সঙ্গে খেলে গেছেন ঘরোয়া ক্রিকেট। তিনি বেশি খেলেছেন আজাদ বয়েজে। এ ছাড়া আবাহনী, মোহামেডান, বিমান, কলাবাগানেও খেলেছেন। খেলা ছেড়ে দেয়ার পর সামিউর রহমান প্রথমে আম্পায়ারিং, পরে ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করে গেছেন অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত।
সামিউর রহমানকে নিয়ে তারই সতীর্থ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, ‘সামির পরিবারের সঙ্গে ছিল আমার ভালো যোগযোগ। তার বড় ইউসুফ বাবু ছিল আমার বন্ধু। তাদের পিতার সঙ্গেও আমার ভালো পরিচয় ছিল। তার মতো আউট সুইং বোলার আমি কমই দেখেছি। লোয়ার অর্ডার ও লোয়ার মিডল অর্ডারে হার্ড হিটিং ব্যাটিং ভালো করত। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর আম্পায়ারিং ও ম্যাচ রেফারি হিসেবে সবার কাছে যথেষ্ট সম্মান পেয়েছে। তার মাঝে চাওয়া-পাওয়ার কিছু ছিল না।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু খুব কাছ থেকে দেখেছেন সামিউর রহমানকে। মারা যাওয়ার দুই/তিন দিন আগেও তাকে দেখে এসেছেন। তাকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘তার বোলিং রান আপ এতো সুন্দর ছিল যে চোখে পড়ার মতো। নতুন বলে তার আউট সুইং ছিল খুবই কার্যকরি। ফিল্ডিং ভালো করতেন। লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিংও ভালো করতেন। এখন যেমন একজন ক্রিকেটারকে জানতে হলে নেটে গেলেই পাওয়া যায়, সে সময় এ রকম নেট সুবিধা ছিল না। কিন্তু যারা তার খেলা দেখেছেন, তারা বলতে পারবেন তিনি কতো উঁচু মাপের বোলার ছিলেন।’
এমপি/এসএ/