মোস্তাফিজ ভেবে রেখেছিলেন ৫ উইকেট পাবেন!
বিশ্ব ক্রিকেটে ভারত মহাপরাক্রমশালী। তাদের ব্যাটিং লাইন গুড়িয়ে দেওয়ার মতো অস্ত্র বর্তমান বিশ্বে খুব কমই আছে। এমন একটি দলের বিপক্ষে কোনো সাফল্য পাওয়া মানে রাতারাতি তারকা বনে যাওয়। সেই কাজটিই মোস্তাফিজ করেছিলেন ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে নিজের অভিষেক ম্যাচে। প্রথম ম্যাচেই ৫ উইকেট। পরের ম্যাচে ৬ উইকেট। ভাবা যায়। অকল্পনীয়। দুই ম্যাচ জিতে তিন ম্যাচের সিরিজ বাংলাদেশের। পরের ম্যাচে ২ উইকেট। ম্যাচ হেরে যায় বাংলাদেশ। অভিষেকেই ৩ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে মোস্তাফিজ তখন তারকা। উড়ছেন আকাশে। হয়ে উঠেন লাল-সবুজের আশা-ভরসার প্রতীক। সেই শুরু আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
মোস্তাফিজের কাটারে ২২ গজে কতো ব্যাটসম্যানের প্রাণ গিয়েছে। তার এ রকম প্রাণ সংহারি ভূমিকায় হেসেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে জমজমটা ও দামি ফ্রাঞ্চাইজি লিগ আইপিএলে প্রথমবারের মত খেলতে গিয়েও তারকা বনে যান। পুরস্কার পান সেরা ইমার্জিং ক্রিকেটারের। কিন্তু হঠাৎ করেই তার সেই সাফাল্যে ঘটে ছন্দপতন। ক্রমান্বয়ে তা নিচের দিকে নামতে থাকে। তার বিখ্যাত কাটার হয়ে উঠে ভোতা। দলে মোস্তাফিজের প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস পেতে শুরু করে। সেরা একাদশ থেকে বাদ দিতেও ম্যানেজমেন্ট কুণ্ঠিত হয়নি। এমনকি আইপিএলও তিনি হয়ে উঠেন অনিয়মিত। এবারের আইপএলে তিনি খেলতে পেরেছেন মাত্র ২টি ম্যাচ।
সেই মোস্তাফিজকে আবার দেখা গেছে চেনা রূপে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে ম্যাচে তার ঝলকেই নিশ্চিত হারা ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ ৫ রানে। মোস্তাফিজের ভয়ংকর শেষ স্পেলে আইশিদের জেতার আশা গুঁড়িয়ে দেন। খেলা শেষে তার হাতে উঠে ম্যাচ সেরার পুরস্কার। ১০ ওভারে ৪৪ রানে নেন ৪ উইকেট।
মোস্তাফিজের এই ম্যাচ সেরা হওয়া ছিল বলা যায় সফল প্রত্যাবর্তন। দলে ফিরেছিলেন তিনি ৪ ম্যাচ পর। বাদ পড়ার আগে তার অবস্থা ছিল যাচ্ছে তাই রকমের বাজে। ২০২২ সালে ১৯ আগস্ট হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৭ রানে ৪ উইকেট নেওয়ার পর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচের আগে তিনি আর কোনো ম্যাচে একাধিক উইকেট পাননি। ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের সিরিজে ২ ম্যাচে পান ১টি করে উইকেট। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের সিরিজে তার ঝুলিতে ছিল মাত্র ১ উইকেট। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৩ ম্যাচের সিরিজে প্রথম ম্যাচে পেয়েছিলেন ১ উইকেট। তারপর বাদ পড়েন। অতঃপর ফিরেন চেমসফোর্ডে শেষ ম্যাচে। যেখানে ঘটে তার সফল প্রত্যাবর্তন।
মোস্তাফিজের এমন সময় সফল প্রত্যাবর্তন ঘটে যখন ম্যাচ বাংলাদেশের হাত ছাড়া। হারের প্রহর গুনছে। আইরিশদের রান ছিল ৪১ ওভারে ৩ উইকেটে ২২৩ রান। জয়ের জন্য ৫৪ বলে ৭ উইকেটে প্রয়োজন ৫২ রানের। উইকেটে সেট হয়ে যাওয়া দুই ব্যাটসম্যান হ্যারি টেক্টর ও লরকান টাকার। এ সময় নাজমুল হোসেন শান্ত প্রথমবার বল হাতে নিয়েই হ্যারি টেক্টরকে ফিরিয়ে দেন। পরের ওভার থেকেই শুরু হয় মোস্তাফিজ ভেল্কি। টানা ৩ ওভারে তিনি তুলে নেন ১টি করে উইকেট। আর এতেই ধসে পড়ে আইরিশদের জয়ের সম্ভাবনা। মোস্তাফিজ ৩ স্পেলের এই ওভারে ৯ রানে নেন ৩ উইকেট। ম্যাচে ১০ ওভারে ৪৪ রানে ৪ উইকেট নিয়ে তিনি জিতে নেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
ফর্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকা মোস্তাফিজ ম্যাচ সেরা হলেন ৪ বছর পর। সর্বশেষ তিনি ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন ২০১৯ সালে আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশিয় সিরিজে উইন্ডিজের বিপক্ষে। সেই ম্যাচেও তিনি ৪ উইকেট পেয়েছিলেন ৯ ওভারে ৪৩ রান দিয়ে।
ম্যাচ সেরা হওয়া মানেই পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে আসা। কথা বলা। আর এটিই মোস্তাফিজের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ। এটা সবাই জানেন মোস্তাফিজ বোলিং করতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, ততোটাই অস্বস্তিবোধ করেন ব্যাটিং করতে। তারচেয়ে বেশি অস্বস্তিবোধ করেন সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে। যতোাট সম্ভব কম বাক্য ব্যয় করে কথা বলেন। মোস্তাফিজের মুখ থেকে লম্বা কথা বের করার জন্য প্রশ্ন যতোই লম্বা করে করা হোক না কেন, মোস্তাফিজের জবাব সেখানে সংক্ষিপ্ত হবেই। কয়েকটি শব্দে শেষ।
তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে পুরস্কার বিতরণী ম্যাচেও তিনি একই কাজ করেছেন। তার ছোট্ট ছোট্ট জবাবের মাঝে ছিল হাস্যরস। ইংরেজি ভাষায় মোস্তাফিজের দুর্বলতা থাকায় এখানে দোভাষী হয়ে ছিলেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। একাদশে ফিরেই যে তিনি এমন কিছু করবেন এ রকম ভাবনা কি আগে থেকেই ছিল- উপস্থাপক অ্যালান উইলকিন্সের প্রশ্ন তামিম ইকবালের কাছে বাংলা তর্জমা করে শুনার পর মোস্তাফিজ হাসতে হাসতে বলেন, আমি আগের দিনই ভেবেছিলাম ৫ উইকেট পাবো।’ শেষ স্পেলে বল হাতে নেয়ার আগে এভাবে বোলিং করে দলকে জেতানোর আত্মবিশ্বাস ছিল কি? মোস্তাফিজের জবাব আমার তো এটা নরমালই। সব সময়ই তো করি।’ সব শেষে অ্যালন উইলকিন্স জানতে চান ম্যাচ সেরার অর্থ দিয়ে কি করবেন। মোস্তাফিজের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত জবাব ‘শপি’।
এমপি/আরএ/