যত দোষ লিটনের!
জয়-পরাজয় খেলারই অংশ। এটাই স্বাভাবিক। জয়ে যেমন কারও ভুমিকা থাকে খুব বেশি। তিনি হন সর্বত্র প্রশংসিত, তেমনি হারেও থাকে কারও কারও ভুমিকা! তখন তিনি হন সমালোচিত। কিন্তু কখনো কখনো হারের এই সমালোচানা ব্যক্তি বিশেষ খেলোয়াড়কে খুব বেশি আক্রমণ করা হয়ে থাকে! তখন বিষয়টি এমনভাবে তুলে ধরা হয় যে তার কারণেই দলটি হেরেছে। কিন্তু একবারও তখন কেউ ভাবেন না সেই খেলোয়াড়টি ইচ্ছে করে দলকে হারাননি। যে বোলার ছয় বলে ছয় ছক্কা হজম করে দলের নিশ্চিত জয়কে হাতছাড়া করেন, সেই বোলারও মনে প্রাণে চাননি এভাবে ছয় ছক্কা হজম করতে। কিন্তু নিয়তি তাকে ছাড়েনি।
এবারের আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে লিটন দাস নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলতে নেমে ভালো করতে পারেননি। প্রথম বলে বাউন্ডারি মেরে শুরু করলেও পরে আর কোনো রান করতে পারেননি। ৪ বলে খেলে সেই ৪ রানেই আউট হয়ে যান। দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে কলকাতা ১২৭ রান নিয়েও জেতার আশা করেছিল। কিন্তু লিটন দাস সহজ ২টি স্ট্যাম্পিং মিছ করাতে পরে আর জয় পাওয়া হয়নি। কিন্তু হারের পর সব দোষ গিয়ে পড়েছে লিটন দাসের উপর। বিশেষ করে তার ২টি স্ট্যাম্পিং মিছ করাটাকে খুব বেশি হাইলাইটস করা হচ্ছে। বিষয়টি এমন যে এই ২টি স্ট্যাম্পিং মিছ না করলে কলকাতা ম্যাচ জিতে যেত!
ম্যাচ হারের পর যেভাবে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে, তাতে করে মনে হচ্ছে কলকাতা এর আগে ম্যাচ হারেনি। লিটনের কারণেই তাদের অপরাজেয় থাকার রেকর্ড ক্ষুণ্ন হয়েছে! যে কারণে ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে পরের ম্যাচ লিটনকে একাদশে রাখা হয়নি। কিন্তু দিল্লির কাছে হারে লিটনকে বলির পাঠা বানিয়ে বাদ দিয়েও কলকাতা হার এড়াতে পারেনি। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো দিল্লির কাছে কলকাতার ছিল চতুর্থ হার। এই চারটি হারে কিন্তু কাউকে সেভাবে দোষারূপ করা হয়নি। আবার ব্যাঙ্গালুরুর কাছেও হারে কাউকে দোষারোপ করা হয়নি। তবে সানরাইজোর্সের বিপক্ষে নিশ্চিত হারা ম্যাচ রিঙ্কু সিং ৫ বলে টানা ৫ ছক্কায় ম্যাচ জেতানোর পর তাকে নিয়ে তুমুল আলোচনা করা হয়েছে। রাতারাতি তারকা বনে যান তিনি। এমন জয়ের পর রিঙ্কুকে নিয়ে এ রকম মাতামাতি করাটা স্বাভাবিকই।
রিঙ্কুকে যেন নায়ক বানানো হয়েছে, তেমনি লিটনকে অনেকটা ‘খলনায়ক’ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কলকাতার আফগান ক্রিকেটার রহমতউল্লাহ গুরবাজ, যিনি লিটনের মতোই ওপেনার এবং উইকটেকিপার। তিনি কিন্তু বাদ পড়েছেন টানা ৫ ম্যাচ খেলে। এই ৫ ম্যাচের মাঝে তার ব্যাট থেকে রান এসেছে একটি মাত্র ম্যাচে। ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে করেছিলেন ৫৭ রান। আর উইকেটের পেছনে থেকে ক্যাচ ধরেছিলেন মাত্র ৪টি।
শুধু রহমতউল্লাহ গুরবাজই নন, দুই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আন্দ্রে রাসেল ও সুনিল নারিনও কিন্তু ব্যর্থ। কিন্তু তারা দুই জনেই টানা ৭ ম্যাচেই খেলেছেন। রাসেল রান করেছন ১০৭। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৩৮। বল হাতে উইকেট নিয়েছেন ৩টি। তাও এক ম্যাচে। এই ৭ ম্যাচে বোলিং করেছেন মাত্র ৫.১ ওভার। রান দিয়েছেন ৬৮। ওভার প্রতি রান ১৩.১৬। সুনিল নারিন ২৫ ওভার বোলিং করে ২১৭ রান দিয়ে নিয়েছেন ৬ উইকেট। ওভার প্রতি রান দিয়েছেন ৮.৬৮ করে। ব্যাট হাতে রান করেছন ১৩।
এই ৩ ক্রিকেটারের প্রতি কলকাতা নাইট রাইডার্সের টিম ম্যানেজমেন্ট যতটা সদয় ছিলেন, লিটনের প্রতি ছিলেন ততটাই নির্দয়। যে কারণে লিটনের একটি মাত্র ম্যাচকেই তারা কাটা-ছেড়া করেছেন পারফরম্যান্স বিবেচনায়। একটিবারও ভাবেননি ম্যাচটি ছিলে লিটন দাসের আবার আইপিএলে অভিষেক ম্যাচ। আইপিএলের মতো ক্রিকেট দুনিয়া কাঁপানো আসরে প্রথম খেলতে নেমে নার্ভানেস কাজ করবেই। লিটনও তার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
লিটন ব্যর্থ হয়েছেন সত্য। স্ট্যাম্পিং মিছ করেছেন দৃষ্টিকটুভাবে-এটাও সত্য। কিন্তু তাকে যেভাবে ‘ভিলেন’ বানিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে, দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, এতে করে তার মনোবলের উপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়বে-এটাই স্বাভাবিক।
এখন কলকাতার পরবর্তী ম্যাচগুলোতে লিটনকে সেরা একাদশে বিবেচনা করা হবে কি না যেমন প্রশ্ন, তেমনি লিটন সুযোগ পেলে নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলাদেশের ক্রিকেট কোচ ও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন লিটনের মতো ক্রিকেটারকে একটি মাত্র ম্যাচ খেলে বাদ দেওয়া ঠিক হয়নি। সে কি করতে পারে সবারই জানা। তিনি বলেন, ‘লিটনকে আরেকটি ম্যাচ সুযোগ দেওয়া যেত পারত। সে কি মানের ক্রিকেটার আমরা সবাই জানি। সে কি করতে পারে আমরা সেটাও জানি। তাকে জেনেই কলকাতা দলে নিয়েছে। যেহেতু তার প্রথম ম্যাচ ছিল। সেখানে নার্ভাসনেস কাজ করতেই পারে। এভাবে একটি ম্যাচ খেলিয়ে তাকে বাদ দেয়া ঠিক হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কলকাতা কিন্তু খুব ভালো পজিশনে নেই। দল হিসেবেও ভালো করতে পারছে না। এই সব বিবেচনা করে লিটনের মতো ক্রিকেটারকে বাদ না দিয়ে খেলালে কলকাতাই লাভবান হতো।’
নাজমুল আবেদীন ফাহিম লিটনকে বাদ দেওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে বলেন, ‘লিটনকে তারা খুব বেশি ম্যাচ পাবে না। তাকে পরের ম্যাচ সুযোগ দিয়ে সে যদি ভালোও করত, তাতেও কিন্তু কলকাতার খুব একটা লাভ হতো না। কারণ লিটনকে তো চলে যেতেই হবে। তাই তারা হয়তো ভেবেছে যেহেতু চলে যাবে, তাই আগে থেকেই তার জায়গায় একজনকে সেট করে নিচ্ছে।’
এমপি/এমএমএ/