সৌরভ গাঙ্গুলির স্মৃতির জানালায় বাংলাদেশ
কলকাতার মহারাজ সৌরভ গাঙ্গুলির জীবনে বাংলাদেশের নামটি বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে আছে। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সফল অধিনায়ক বাঙালি বাবুর জীবন অনেক ‘প্রথম’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে সেই ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে আসা দিয়ে তার যাত্রা শুরু। তারপর তার অধিনায়কত্বে প্রথম টেস্ট খেলতে আসা, যা ছিল আবার বাংলাদেশেরও প্রথম টেস্ট। আবার ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে গোলাপি বলে প্রথম টেস্টে আয়োজনেও ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশ। এসব স্মৃতিচারণ তিনি করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আয়োজিত মেয়র কাপের লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানে।
দাদাগিরির দাদা মঞ্চে উঠে কথা বলেন পুরোটাই বাংলায়। খুলে ধরেন স্মৃতির ঝাপড়ি। হয়ে পড়েন আবেগ আপ্লুত। তার প্রায় ১২ মিনিটের বক্তৃতার অনেকটা জুড়েই ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে তার মধুর স্মৃতিচারণ। স্মৃতির ডানা মেলে অতীতে ফিরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যাদের সঙ্গে আমি বহুদিন ক্রিকেট খেলেছি আকরাম আছে, আতাহার আছে, পাইলট আছে। আমি অনেক দিন বাদে ঢাকা এসেছি। লাস্ট ঢাকা এসেছিলাম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (২০১৪ সাল) সময়। ভারত ফাইনালে হেরেছিল শ্রীলঙ্কার কাছে। এরপর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে যুক্ত হওয়া এবং অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হওয়ার জন্য আর আসা হয়নি। একটি কথা আমি সব সময় বলি যতবার আমি এখানে আসি, আমি এত মানুষের ভালোবাসা পাই, আমি বুঝতে পারি না যে এটা ভারত না বাংলাদেশ। আমাকে এত ভালোবাসা, নিজের মনে করার জন্য আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।’
সৌরভ গাঙ্গুলি তার প্রথম বাংলাদেশে আসার কথা স্মরণ করতে গিয়ে সময় উল্লেখ করতে গিয়ে কিছুটা গড়বড় করে ফেলেন। ১৯৮৯ সাল না ১৯৮৭ সাল। এই দুইটা সাল বলার পরই তিনি নিশ্চিত হয়ে বলেন ১৯৮৯ সালের কথা, ‘আমি বাংলাদেশে প্রথম আসি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ১৯৮৯ সালে এশিয়া কাপ খেলতে। সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সর্ম্পক। প্রচুর মানুষ বন্ধু আমার। মিঠুর কথা শুনলেন, ইফতেখার রহমান। সেই দিন থেকে আমার বন্ধু। আমি হয়তো ১০ বছর বাংলাদেশে আসিনি। কিন্তু তার সঙ্গে, তার পরিবারের সঙ্গে, বাকি বন্ধুদের সঙ্গে আমার পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় দেখা হতো।’
বাংলাদেশের টেস্ট মযার্দা পাওয়ার পেছনে রয়েছে ভারতের অকৃপণ সহযোগিতা। সেই সময় জগমোহন ডালমিয়া ছিলেন আইসিসিরি সভাপতি। তিনি আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ যাতে টেস্ট মযার্দা পায়। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ভোট না পাওয়ায় ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ আর টেস্ট মর্যাদা পায়নি। কিন্তু পরেরবার ঠিকই আদায় করে নেয়। এরপর একই বছরের ১০ নভেম্বর ভারত এসে খেলে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট। এখানেও ছিল ডালমিয়ার অবদান।
এদিকে ভারত বাংলাদেশ আসে তাদের নতুন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে। সেটি ছিল ১ হাজার ৫১২তম টেস্ট ম্যাচ। সৌরভ গাঙ্গুলি বলেন, ‘আমার প্রথম টেস্ট অধিনায়কত্ব বাংলাদেশে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের সঙ্গে আমার নাম সব সময় জড়িয়ে থাকবে। কারণ ওটা ছিল বাংলাদেশেরও প্রথম টেস্ট ২০০১ সালে (হবে ২০০০ সালে)। আমার এখনো মনে আছে, তখন নতুন স্টেডিয়াম হয়নি। পুরোনো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ বোধ হয় ফার্স্ট ইনিংস লিড নিয়েছিলাম তাই না? (বাংলাদেশ লিড নিতে পারেনি। বাংলাদেশ করেছিল ৪০০ রান। ভারত করেছিল ৪২৯ রান)। তারপর যখন ড্রেসিংরুমে ডুকি, আমার মনে হল একি, আমি কি আমার অধিনায়কত্বের প্রথম টেস্ট হেরে যাব? তারপর ফিরে এসে আমরা টেস্ট জিতি।’
খেলোয়াড় হিসেবে গাঙ্গুলি বাংলাদেশে প্রথম খেলতে আসেন ১৯৯৮ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাপে। ফাইনালে পাকিস্তান ৫ উইকেটে ৩১৪ রানের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। সৌরভ গাঙ্গুলির ১২৪ রানে ভর করে ভারত সেই রান তাড়া করেছিল ৭ উইকেট হারিয়ে ৪৭.৫ ওভারে। আজকের বক্তব্যে গাঙ্গুলি সেই ফাইনালেরও স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার জীবনের বহু বহু মূল্যবান মুহূর্ত জড়িত বাংলাদেশের সামনে। আমার এখনো মনে আছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাপের ফাইনালে আমরা পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩১৫ রান চেজ করে জিতি। তখনকার দিনে ৩১৫ রান চেজ করা খুবই কঠিন ব্যাপার ছিল। আমার এখনো মনে আছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তখন এত আলো, ফ্লাডলাইট ছিল না। ফুটবলের আলোয় খেলা হয়েছে। শেষ অব্দি আমরা ম্যাচটা জিতেছিলাম।’
‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ সৌরভ গাঙ্গুলি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গোলাপি বলের দিবা-রাত্রির ভারতের প্রথম টেস্টের প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিলেন। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে মহাযজ্ঞ আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও উপস্থিত ছিলেন মাঠে।
সৌরভ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়েও খুব ওয়াকিবহাল। বাংলাদেশের গান, বাংলাদেশের সংস্কৃতি। গান হলো বাংলাদেশের হৃদস্পন্দন। বহু বিখ্যাত গায়ক-গায়িকা বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে গেছেন। আমার এখনো মনে আছে যখন প্রথম পিংক টেস্ট হয়। এটাও হয়তো কাকতালীয়। আমি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে প্রথম পিংক টেস্টও আয়োজন করেছিলাম বাংলাদেশের বিপক্ষে। আপনাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন কলকাতায় আমার আমন্ত্রণে ওই টেস্ট ম্যাচ দেখতে। অনেক মধুর সময় কেটেছে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে।’
সৌরভ গাঙ্গুলি তার বক্তব্যে মাদকের ব্যাপারে বাংলাদেশের যুব সমাজ নিয়েও কথা বলেন। তার বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে তিনি আবারও স্মৃতিকাতর হয়ে আরেকবার আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমি আবারও বলি। আমি যতবার বাংলাদেশে আসি, আমার অসাধারণ ভালো লাগে। এত মানুষের ভালোবাসা। আর ভালোবাসা মানে জেনুইন ভালোবাসা। এই জেনুইন ভালোবাসা দেখে আমি আপ্লুত হই। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। এখানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য মিঠুকে, মেয়র সাহেবকে ধন্যবাদ।’
এমপি/এসজি