অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র: নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা
জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। সবকিছু ঠিক থাকলে ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম দিকে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ অবস্থায় এখনই বাড়ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। এ সব আগ্নেয়াস্ত্র সীমাস্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে।
জানা যায়, রাজধানীসহ সারাদেশে এখন অপরাধীদের হাতে হাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। শীর্ষ সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, জঙ্গি থেকে শুরু করে পাড়ার ছিঁচকে মাস্তানরাও এ সব ব্যবহার করছে। নিয়মিত অভিযানে মাঝে মধ্যেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারও করছে র্যাব–পুলিশ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সব অবৈধ অস্ত্র যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায়, তাহলে দিন দিন এর ব্যবহার বাড়বে এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশের প্রায় ৩০টি রুট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে প্রবেশ করছে। বৈধ অস্ত্রের আড়ালেও আসছে অবৈধ অস্ত্র। এ ছাড়া দেশেও অস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাধিত সহস্রাধিক অস্ত্র উদ্ধার করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এ সব ঘটনায় সারাদেশে প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে আসছে অত্যাধুনিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। তবে বেশি আসছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইয়াবা দেশের অভ্যন্তরে এলেও বর্তমানে সেখান থেকেও অস্ত্র কিনছে চোরকারবারীরা।
অতিসম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর খোদ রাজধানীতে মাদক উদ্ধার করতে গিয়ে অস্ত্রও জব্দ করেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, অস্ত্রগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) অভিযানে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও বেড়েছে।
সূত্র বলছে, চোরাকারবারীরা এ সব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র কৌশলে সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢোকাচ্ছে। এরপর হাত ঘুরে অ্যাম্বুলেন্স কিংবা জরুরি যানবাহনে ঢাকাসহ চাহিদা মোতাবেক ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সারাদেশে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এক শ্রেণির চক্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে অস্ত্র মজুতের চেষ্টা করছে। তবে নজরদারির কারণে ধরাও পড়ছে।
গত ৮ মে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ‘ইলিশ’ বাস কাউন্টারের সামনে থেকে মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে অত্যাধুনিক দুটি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন এবং ৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতিঝিল সার্কেল।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্ল্যাহ কাজল এ প্রসঙ্গে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির কাছে ব্যাগভর্তি ইয়াবা রয়েছে। কিন্তু ব্যাগ খুলতেই বেরিয়ে আসে লোডেড দুটি আধুনিক বিদেশি পিস্তল।
গ্রেপ্তাররা রতনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অস্ত্রগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আনা হয়েছে। অস্ত্রের গন্তব্য কোথায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ ছাড়াও চট্টগ্রাম, লক্ষীপুর, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকা থেকে অতিসম্প্রতি অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা রয়েছে। সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় বিজিবির অভিযানেও নিয়মিত ধরা পড়ছে অস্ত্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে সীমান্ত পথে ভারত থেকে খুব সহজেই অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। নির্বাচনকালে হওয়ার কারণে বর্তমানে তা আগের চেয়ে বেড়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র কৃষক ও দিনমজুরদের অস্ত্র বহনে বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাংলাদেশি অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা অস্ত্র যাচ্ছে রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, ভূমিদস্যু এবং সন্ত্রাসীদের হাতে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবির) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হারুনুর অর রশিদ জানান, বিভিন্ন সময়ে একাধিক অস্ত্রের চালান জব্দ করেছে ডিবির টিম। এসব ঘটনায় একাধিক অস্ত্র ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হয়েছে। অবৈধ অস্ত্রৈর ব্যবসা, চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ওপর নজরদারির পাশাপাশি তাদের গ্রেপ্তারে সবসময় ডিবি কাজ করে যাচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমানের তত্ত্বাবধায়নে দুজন অতিরিক্ত উপকমিশনারের টিম অস্ত্রের চালানটি আটক করার পাশপাশি পাঁচ অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে। ওই চক্রের দলনেতা আকুল হোসেন। এ চক্রের শেকড় খুঁজে পেতে ৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান চালানো হয়। অবশেষে আকুলের গ্রুপের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও এ চক্রের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা মেহেদীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি ভারতে অবস্থান করার কারণে।
গত ৭ বছরে আকুল যেসব ব্যক্তির কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে, তার মধ্যে ২৫ জনের নাম পেয়েছে আইনশৃঙ্কলা বাহিনী। এসব ব্যক্তির কাছে আকুলের কাছ থেকে কেনা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে আকুলের সবরাহ করা আড়াইশ অস্ত্র কাদের হাতে গেছে, তাও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগের (লালবাগ) উপ কমিশনার মশিউর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সামনে যেহেতু নির্বাচন একটি চক্র চাচ্ছে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে। তারাই অস্ত্র আনছে। আমরা সজাগ রয়েছি।
ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু এক চক্রের হাত দিয়েই যদি আড়াইশ অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাহলে এমন আরও একাধিক চক্র রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সীমান্ত এলাকায় দুর্বল নজরদারি থাকার কারণে অবৈধ অস্ত্র সহজে ভারত সীমান্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশে আসছে। এ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতাদেরও সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
এ সব কর্মকর্তা বলছেন, মূলত অবৈধ অস্ত্রের হাতবদল একেক সময় একেক ধরনের কৌশল নেওয়া হয়। অবৈধ অস্ত্রের মজুদ নানা প্রয়োজনে গড়ে তোলা হয়। জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় নির্বাচনকে ঘিরেও অবৈধ অস্ত্রৈর চালান আসতে থাকে ভারত থেকে। এ ছাড়া জমি দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য নিয়ন্ত্রণেও অবৈধ অস্ত্রের মজুদ গড়ে উঠছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বছরজুড়েই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে র্যাব। যেহেতু নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই সীমান্তসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, র্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন অবৈধ অস্ত্রৈর মালিক, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নজরদারি শুরু করেছে। অবৈধ অস্ত্র পাচার ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত চক্রকে গ্রেপ্তারও করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কেউ চেষ্টা করলে সেটি প্রতিহত করা হবে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২২ সালে দেশে ৪৭৫টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭০ জন মারা গেছেন। আর চলতি বছরে প্রথম তিন মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা ধরে রাখতে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়।
আরইউ/আরএ/