১৩ বছরে ভোক্তা অধিদপ্তরের জরিমানা ১১০ কোটি
কঠোর হুশিয়ারির পরও অসাধু ব্যবসায়ীদের কোনোক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংক্ষরণ অধিদপ্তর জরিমানা করার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৩ বছরে সংস্থাটি ১ লাখ ৫৮ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ১১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, শুধু চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের ৯ মাসেই প্রায় ২২ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ১৬ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠার বছরই ২০০৯-১০ অর্থবছরে সীমিত জনবল নিয়ে বিভিন্ন অপরাধে ৫৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
কোনও অভিযোগকারী প্রতারিত হলে আর সেই অভিযোগ প্রমানিত হলে তাদের ২৫ শতাংশ প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৮ হাজার ২৭৩ জনকে প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে ক্ষমতায় এসেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ প্রণয়ন করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গঠন করে আওয়ামীলীগ সরকার। প্রতিষ্ঠানটি ভোক্তাদের স্বার্থে বিভিন্ন বাজারে ভেজাল বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি ও ভোক্তা আইনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে অবহিত করেন। একই সঙ্গে ভোক্তাদের স্বার্থবিরোধী কোনো অপরাধ পেলে জরিমানাও করছে।
চাল, ডাল, তেল, মুরগি, ডিম থেকে শুরু করে বাচ্চাদের চকলেট, জুস এমন কোনো পণ্য নেই যে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলে বিক্রেতাদের ঠকাচ্ছে না। বিশেষ করে রমজান মাস এলেই ভোক্তাদের কাছে বেশি দাম আদায়সহ বিভিন্ন উপায়ে বেশি করে ঠকানো হচ্ছে। ভোক্তা অধিদপ্তর একটু তৎপর হলেই তা ধরা পড়ছে।
ভোক্তাদের অভিযোগ, এই রমজান মাসেও ব্যবসায়ীদের লালসার শিকার তারা। সুযোগ পেলেই ব্যবসায়ীরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার উৎপাদন, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য আদায়, অনুমোদনহীন রং মিশিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে থাকায় ভোক্তা অধিদপ্তরও সারা দেশে কাজের পরিধি বাড়িয়েছে। সারা দেশে তাদের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে অভিযানও বেড়েছে। ফলে বেশি বেশি জরিমানাও করা হচ্ছে। এ জন্য জরিমানার পরিমাণও বাড়ছে।
২০১০-১১ অর্থবছরে দেড় হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। পরের বছরে ২ হাজার ৬৬৩টি প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৩ হাজার প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং পরের বছরেও প্রায় ২ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
এভাবে যতই দিন যেতে থাকে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতাও বেশি করে ধরা পড়ে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে। পরের বছরে অভিযানের মাত্রা আরও বাড়তে থাকায় জরিমানার পরিমানও বাড়ে। ওই বছরে ৫ হাজারের বেশি ব্যবসায়ীকে ৩ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অভিযানের পরিমান আরও বাড়তে থাকায় জরিমানার পরিমানও দ্বিগুণ হয়ে যায়। ১০ হাজার ৭২৯টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৭ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পরের বছরে আরও বেশি ১৩ হাজার ৬৫২ ব্যবসায়ীকে ১৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২০ হাজার ৭০৩ ব্যবসায়ীকে ১৬ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পরের বছরে ২৩ হাজারের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৩ হাজার ৬৮১ ব্যবসায়ীকে প্রায় ১৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২৬ হাজার ২৩৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ১৮ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে।
চলতি মাসেও বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও অনুমোদনহীন রং ব্যবহার করে লাচ্চা সেমাই উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ করছে মধুমতি মডেল টাউন এলাকায় সাহানা ফুড প্রডাক্টস, গান্ধারিয়া এলাকায় নাসির ফুড প্রডাক্টস ও নাসির ফুড প্রডাক্টসকে জরিমানা করা হয়েছে।
বিভিন্নভাবে হুঁশিয়ারি করার পরও ভোক্তাদের ঠকানো কমছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই অতি মুনাফা করার চেষ্টা করছে। ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। এ জন্য বিভিন্নখাতের সংশ্লিষ্ট মালিক, পাইকারিও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা হচ্ছে। তাদের আইন সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। তারপরও কেউ আইন অমান্য করে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করলে জরিমানা করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসঙ্গতি পেলে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করা হচ্ছে।
তারপরও কেন বাজারের অস্থিরতা দূর হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সরকারের এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, দেখেন মুরগি ও ডিমের ব্যাপারে দেখার দায়িত্ব মৎস ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের। তারপর হঠাৎ করে দাম বাড়ানোর কারণে ফার্ম মালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ডেকে কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। এভাবে কসমেটিকস থেকে শুরু করে ভোক্তাদের জন্য সব ক্ষেত্রেই অসঙ্গতি ধরা পড়লে তা ধরা হচ্ছে। এভাবে তাদের ধরার কারণেই রমজানটা কিছুটা টেনশনে থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা অত তৎপর হতে পারেনি।
একই ব্যবসায়ীদের কয়েকবার জরিমানা করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে মহাপরিচালক বলেন, অতি মুনাফার লোভ সামলাতে না পারার কারণেই নীতি নৈতিকতাকে তোয়াক্কা করছে না তারা। এজন্য কোনো বাজারে অসঙ্গতি ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট বাজার কমিটিকেও শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
আরইউ/এএস