বায়ুদূষণে নবজাতকের ওজন কম, বাড়ছে মৃত্যু
বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন অসংখ্য শিশু মারা যাচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, আইসিডিডিআরবি’র প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি বলছে, বায়ুদূষণের কারণে এসব শিশুরা জন্মের ১ থেকে ২ মাসের মধ্যেই মারা গিয়েছে৷
শিশুদের মায়েরা গর্ভাবস্থায় উচ্চ মাত্রায় বায়ুদূষণের সংস্পর্শে আসার কারণে ও শিশুদের ওজন কমায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছরে আমাদের দেশে মারা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিশু। বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ে মাতৃস্বাস্থ্য ক্ষতির মুখে পড়ছে। যার কারণে জন্মের আগে ও পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে এসব শিশুরা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিষয়ে যদি মাতৃস্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া না হয় তাহলে দিনদিন এর সংখ্যা বাড়তে পারে। এ ছাড়া, এই মাতৃস্বাস্থ্যের ঝুঁকির কারণে জন্মের পর শিশু নানা রকমের শারীরিক জটিলতার মধ্যে পড়ছে।
বায়ুদূষণের সার্বিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবি আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু হাসপাতালের প্রায় ৩ শতাধিক প্রসূতি এবং বেশকিছু নবজাতকের উপর গবেষণার তথ্য দিয়ে মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কিছু শিশু জন্মের পর বিশ্লেষণ করে আমরা জানতে পেরেছি বায়ুদূষণের কারণে অনেক শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। আমরা গবেষণায় ধারণা করছি বায়ুদূষণ মাতৃস্বাস্থ্যের ব্যাপক হারে ক্ষতি করছে যার কারণে প্রতি বছরে লক্ষ লক্ষ শিশু মারা যাচ্ছে।
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু হাসপাতালের নিচ তালায় কথা হয় পলাশী স্টাফ কোয়ার্টারে ভাড়া থাকা ব্যক্তি নরসিংদীর মো. মুকুলের সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমার বাচ্চাটার বয়স আজ ১৭ দিন। জন্মের পর ওর ওজন একটু কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডাক্তার। এজন্য আমার শিশুটিকে পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
একই হাসপাতালে ৩ তলায় ৪০ দিনের শিশু নিয়ে ৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি আছেন তুষার নামের আরেক ব্যক্তি। তুষার বলেন, এখানেই আমাদের বাচ্চা হয়। বাচ্চা জন্মের সময় ৭ দিন হাসপাতালে ছিলাম। বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি হয়। ওজন কম হওয়ায় ৭ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। এজন্য আমাদের শিশুটি নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছে।
শিশু হাসপাতালে বাচ্চা নিয়ে ভর্তি রয়েছেন যশোরের হিরা খাতুন ও শবনব মাকসুদা। তারা জানান, জন্মের পর তাদের শিশুদের ওজন কম হওয়ায় ১০ দিন ধরে তাদের বাচ্চাদের নীবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু মুকুল ও তুষার নয় এমন অসংখ্য পরিবারের শিশুরা বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম বলেন, কোনো নারী যদি কম ওজনের শিশুর জন্ম দেয় তাহলে আমাদের এক গবেষণায় দেখা গেছে জন্মের আগে ওই শিশু বায়ুদূষণের প্রভাবের কারণে এমনটা হতে পারে।
তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে বায়ুদূষণের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের অপুষ্টিও বড় একটি কারণ। যার কারণে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে গর্ভবতী নারীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।
অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম আরও বলেন, সাধারণ শিশুর জন্মের সময় আড়াই কেজি থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত ওজনের স্বাভাবিক হয়ে তাকে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে ২ কেজির কম অনেক বাচ্চা আছে যাদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব বিষয়ে আমরা জরিপ করে দেখেছি তাদের মায়েরা বায়ুদূষণ ও অপুষ্টির কারণে এসব বাচ্চার এ সমস্যা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে চলতি বছরের এ পযর্ন্ত কম ওজনের প্রায় ৫ শত শিশুকে হাসপাতালের নীবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণের ফলে গত বছরে সারা বিশ্বে প্রায় ৬ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করা এক গবেষণায়। গবেষণাটি করেছে মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র হেলথ অ্যাফেক্ট ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড এভালুয়েশন।
অন্যদিকে, আইসিডিডিআরবি’র একটি তথ্য বলছে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বায়ু দূষণ বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। আইসিডিডিআরবি বলছে, বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মারা গেছে ৮০ হাজার মানুষ, ২০২০ সালে ৯০ হাজার, ২০২১ সালে ১ লক্ষ ১০ হাজার, ২০২২ সালে ১ লক্ষ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছর ২০২৩ সালের মার্চ পযর্ন্ত প্রায় ৩০ হাজার ৭৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়।
মোট ৫ বছরে বায়ুদূষণের কারণে ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার ৭৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করছে আইসিডিডিআরবি’র গবেষণা। গবেষণা বলছে, এর মধ্যে হাজার হাজার শিশু রয়েছে যারা মায়ের গর্ভে থেকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করছে।
ঢাকায় সন্তানসম্ভাবা মায়েদের উপর বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) বাংলাদেশের গবেষকরা বলছেন, সম্প্রতি ৫ হাজারেরও বেশি নবজাতককে নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার বেশি। অকালে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক ডা. এ আর হাওলাদার বলেছেন, বায়ুদূষনের কারণে চোখ জ্বালাপোড়া করে, মাথা ধরে, গর্ভবতী নারীদের সমস্যা হয় যার প্রভাব বাচ্চার উপর পড়ে।
অনেক সময় দেখা গেছে পেটের মধ্যেই শিশুরা নিউমোনিয়া বা অন্যরোগে আক্রান্ত হয়। অনক সময় নারীরা অপুষ্টির শিকার হতে পারেন। জনস্বার্থ বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সবাইকে এই বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে।
বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর অধ্যাপক ডা. নিলুফা আখতার বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার প্রাণ চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও এ সংখ্যা কম নয়। বাচ্চারা মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় এসবে আক্রান্ত হচ্ছে। জন্মের পর তাদের ওজন কম হচ্ছে। অনেকেই প্রথমে বুঝতে পারছেন না যে কি কারণে তাদের শিশুর ওজন কম হয়েছে।
তিনি বলেন, এসব বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে তাহলেই বাংলাদেশে শিশুদের মৃত্যুর হার অনেকটা কমে আসবে।
এনএইচবি/এমএমএ/