বৈশাখ ও ঈদ সামনে রেখে জঙ্গিদের বিষয়ে সতর্ক গোয়েন্দারা
পহেলা বৈশাখ ও ঈদ সামনে রেখে জঙ্গিদের নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, আপাতত জঙ্গিদের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। কিংবা হামলার কোনো পরিকল্পনাও তাদের নেই। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জঙ্গিদের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সতর্ক রয়েছেন। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের এক বৈঠকে পুলিশ প্রধান এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক দায়িত্বশীল কমকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, উৎসব এলে অনলাইন ও বিভিন্ন মাধ্যমে জঙ্গিদের কার্যক্রম বা তৎপরতা বেড়ে যায়। এজন্য মনিটরিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি জঙ্গিদের ধরতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
গত বছরের ২০ নভেম্বর ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশের চোখে-মুখে পিপার স্প্রে প্রয়োগ করে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। এদের কাউকেই এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। ইতোমধ্যে ৫ মাস পার হয়ে গেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি জঙ্গিদের নিয়মিত মনিটরিং না করে এবং তাদের হামলা করার সক্ষমতা ভেঙে না দেয় তাহলে তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে যেতে পারে। আদালতের ঘটনা তার প্রমাণ। বিশ্লেষকদের দাবি, জঙ্গিদের নিয়মিত নজরদারিতে রাখতে হবে। নজরদারি কমে গেলে জঙ্গিরা সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইবে।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, চলমান রমজান, বাংলা নববর্ষ ও ঈদকে মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সতর্ক ও প্রস্তুত রয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান বলেন, জঙ্গিদের কাযর্ক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে। তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা শক্ত হাতে দমন করা হবে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া আছে, জঙ্গিরা যাতে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সেই বিষয়ে লক্ষ রাখতে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা অনেকেই বর্তমানে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। বাইরে থাকা জঙ্গিরা হলেন- সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক (মেজর জিয়া), আমীর আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, দাওয়াতী শাখার প্রধান মায়মুন, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিব, রাজীব, বাশারুজ্জামান, রিপন, খালেদসহ অনেকেই এখনো ধরা পড়েনি। তাদের নিয়ে অনেকটা উদ্বেগে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
র্যাবের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, বর্তমানে জঙ্গিরা পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং তারা বয়সে অনেক ছোট। এজন্য জঙ্গি সংগঠনের নেতারা তাদের কোথাও হামলার চেষ্টা করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে র্যাবের গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে।
র্যাবের গোয়েন্দা তথ্য মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গি নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ায় যোগদান করেছে এবং তারা সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। র্যাব ইতোমধ্যে তাদের ১০ জনকে গ্রেপ্তার করছে। তবে, এখনো বাইরে রয়েছে ৪৫ জন জঙ্গি। বাইরে থাকা জঙ্গিরা পাহাড়ের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মূলত তারাই বিভিন্ন জায়গায় হামলার পরিকল্পনা করতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, জঙ্গিদের আমরা কঠোর নজরদারির মধ্যে রেখেছি। র্যাবের প্রতিটি সদস্য সম্মিলিতভাবে জঙ্গি দমন বা অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যেকোনো স্থানে যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে নিয়োজিত। তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন অভিযানে অসংখ্য জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি এবং তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছি। তবে নতুন কিছু জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষিত যুবকরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের হামলার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এসব বিষয় মাথায় রেখে ও বিভিন্ন উৎসব মাথায় রেখে আমরা সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদারে কাজ করছি।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি)তথ্য মতে, হলি আর্টিজান হামলার ৮ বছর পর এসে অনলাইনে কিছু জঙ্গি সংগঠন এখনও সক্রিয়। বর্তমানে তারা দেশের বিভিন্ন পাহাড়কে বেছে নিচ্ছে এবং অনলাইনে নতুন নতুন কর্মীদের সংখা বাড়িয়ে বিভিন্ন অপরাধের ট্রেনিং করাচ্ছে।
জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আদলত থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার পর সম্প্রতি দেশে জঙ্গিবাদী প্রত্যক্ষ কোনো অপতৎপরতা লক্ষ্য করা না গেলেও অনলাইনে তাদের তৎপরতা আগের তুলনায় বেড়েছে। অফলাইনে জঙ্গিদের তৎপরতা নেই, তবে তারা অনলাইনে সক্রিয়। এজন্য নগরবাসীর উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কোনো ঘটনা ঘটার আগেই জঙ্গিদের আমরা গ্রেপ্তার করছি।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জঙ্গি বা অন্যান্য সন্ত্রাসীদের হামলা চালানোর কোনো ক্ষমতা নেই। এ ছাড়া কোনো জঙ্গি সংগঠন পূর্ব বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কোথাও হামলা করে না। বিভিন্ন উৎসব এলে তারা সক্রিয় হতে চায়, তবে তাদের মেরুদণ্ড আমরা বারবার ভেঙে দিচ্ছি এবং এসব বিষয়ে আমরা অতিরিক্ত সতর্ক রয়েছি।
তিনি বলেন, উৎসবকে সামনে রেখে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী যাতে কোনো ধরনের নাশকতা সৃষ্টির সুযোগ না পায় সেজন্য সিটিটিসির গোয়েন্দা তৎপর রয়েছে।
এই বিষয়ে জনাতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (আব) আব্দুর রশীদ বলেন, জঙ্গিদের যদি সরকারি বাহিনীর সদস্যরা মনিটরিং বা চাপের মুখে না রাখে তাহলে তারা অনেক ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করবে। তবে সম্প্রতি আদালত থেকে ২ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। মানুষের মনে আরেকটা ধারণা তৈরি হয়েছে ১৩৩ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো জঙ্গিদের কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি। এর দায়ভার তারা আইনের লোকের উপর যায় এবং সরকারি বাহিনী এটা এড়িয়ে যেতে পারে না।
এনএইচবি/এসএন