মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারে বাড়ছে বিস্ফোরণের ঘটনা
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় নিয়মিতই ঘটছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে যানবাহন ও চায়ের দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে বাড়ছে হতাহতের ঘটনা। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) রাজধানীর জয়কালী মন্দিরের সুইপার কলোনিতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় ৩ জন দগ্ধ হয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে সিএনজি, এলপিজি, অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া, নাইট্রোজেন, হিলিয়ামসহ বিভিন্ন গ্যাসের মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের কারণে। সেইসঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে নকল সিলিন্ডার।
বিভিন্ন ঘটনার তদন্তে জানা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব সিলিন্ডারের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় গাড়ি এবং বাসাবাড়িতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার ও নকল সিলিন্ডারের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেকেই জানেন না কীভাবে সিলিন্ডারের ব্যবহার করতে হয়। এর ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষের অসচেতনতার কারণে সিলিন্ডার গ্যাস এখন বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বছর কয়েক আগে রাজধানীসহ সারা দেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় রীতিমত আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। তখন সরকারের পক্ষ থেকে গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা (রি টেস্টিং) করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময়ে প্রায় সকল বাসা-বাড়ি, চায়ের দোকান ও যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার টেস্ট করার হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু গত কয়েক বছরে গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা কমে গেছে। ফলে আবারও দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। নিয়মিত সিলিন্ডার পরীক্ষা করা হলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা দেশে ২২ হাজার ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যা ২০২০ সালের দুর্ঘটনার চেয়ে ১ হাজার ৪৯টি বেশি। এক বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে ৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত এক বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ৩৩০ কোটি ১৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৯০ টাকার অধিক ক্ষতি হয়েছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের ফলে ২ হাজার ৫৮০ জন নিহত হন। আহত হয় ১১ হাজার ৯৯৯ জন।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০২২ সালে সারা দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮.৪৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে গ্যাসের সিলিন্ডার বিষ্ফোরণ, ভবনে জমে থাকা গ্যাস ও বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এ ছাড়া, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ১৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং গ্যাসের চুলা থেকে ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার ও অন্যান্য তদন্তকারী গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, চলতি বছর ২০২৩ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে প্রায় ৪ শতাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক মানুষ।
গত ২১ মার্চ ভোরে রাজধানীর মুগদার বেস্ট ইস্টার্ন সিএনজি পাম্পে গ্যাস নেওয়ার সময় ট্রাকের সিলিন্ডার হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়। এ ঘটনায় প্রাণ হারান ট্রাকচালকের সহকারী সাদ্দাম হোসেন (২৫)। আহত হন আরও একজন। আহত হয়েছেন। গত ৯ মার্চ নাটোরের সিংড়ায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে জগদীশ কুমার (৪৫) নামে ১ ব্যক্তি নিহত ও ৩ জন আহত হন। গত ১২ মার্চ গভীর রাতে ময়মনসিংহের ত্রিশালে মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে ৪ আরোহী নিহত হন। এ ঘটনায় দগ্ধ হন আরও ৭ জন।
গত শনিবার (২৫মার্চ) রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে একটি অ্যাম্বুলেন্সের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় অ্যাম্বুলেন্সটি পুড়ে যায়। তবে গাড়িতে কোনো রোগী না থাকায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে সড়কে চলাচলকারি যানবাহন একেকটি চলন্ত বোমা। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে চলন্ত গাড়িতে বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ঘটনা থামানো যাবে না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটিন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রাজধানীসহ দেশের সর্বত্রই এখন সিলিন্ডারের ব্যবহার রয়েছে। কারখানা, যানবাহন এমনকি ঘরের মধ্যে এই গ্যাস ‘বোমা’ রয়েছে। এর বেশিরভাগেরই মেয়াদ নেই।
বিস্ফোরণ ঘটলে এগুলো ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এসব গ্যাস অনেক সময় ক্ষুদ্র পরিসরে বের হয় এবং ভবনের মধ্যে বা বাড়ির মধ্যে জমা হয়ে এটি থেকে বিস্ফোরণ হয়, যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে সাধারণ মানুষকে এসব রোধে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ না এলে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, বছরে সারা দেশে প্রায় সাত লাখ মানুষ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়। এর মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ দগ্ধ ব্যক্তি ঢাকার বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নেয়।
বড় অগ্নিকাণ্ড মানেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। এ ধরনের বিস্ফোরণে দগ্ধদের বাঁচানো সম্ভব হয় না। আগুনের তীব্রতা বেশি হওয়া এবং বিস্ফোরণের পর জলন্ত টুকরো ও বিষাক্ত ভারী ধোঁয়া ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। এতে শ্বাসনালি ও ফুসফুস পুড়ে যায়।
এ অবস্থায় সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েও অনেককে বাঁচানো যায় না। যারা বেঁচে যান, তাদের আজীবন পঙ্গু হয়েই থাকতে হয়। মানুষ যদি এসব বিষয়ে একটু সচেতন হন তাহলে এসব দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে বলে দাবি করেন এই চিকিৎসক।
বুয়েটের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মো. আশিকুর রহমান বলেন, আমাদের দেশের সিলিন্ডার মনিটরিংয়ের ব্যাপক অভাব রয়েছে। বিশেষ করে মনিটরিংয়ের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার সরিয়ে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে গ্যাসের সিলিন্ডারের মধ্যে যাতে কোনোভাবে হাইপ্রেশার না হয়।
তিনি আরও বলেন, গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হওয়ার কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-সিলিন্ডারের মেয়াদ না থাকা ও অনেক সময় বাজারে নকল সিলিন্ডারে গ্যাস ক্রয়-বিক্রয় করা।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় চলন্ত গাড়িতে অতিরিক্ত গ্যাস বহন করা ও সিলিন্ডারের ভেতরে অতিরিক্ত গ্যাসের চাপ প্রয়োগ করার কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। তা ছাড়া, অনেকে ব্যবহার সঠিক মতো জানেন না। আমি মনে করি জেনে বুঝে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করলে বিস্ফোরণের সংখ্যা কমে আসবে।’
এনএইচবি/এমএমএ/