ফৌজদারি মামলায় ১৪ বছরে চাকরি হারিয়েছেন ২২৭ পুলিশ সদস্য
খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশ সদস্যরা সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার অভিযোগও আছে। পুলিশ হয়ে পুলিশ সদস্যকে উঠিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত গত প্রায় ১৪ বছরে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া ও ফৌজদারি মামলায় ২২৭ জন পুলিশকে চাকরি হারাতে হয়েছে। চাকুরি হারানোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হেচ্ছ কনস্টেবল, উপ-পরিদর্শক ( সাব-ইন্সপেক্টর) এবং ওসি।
পুলিশ সদরদপ্তর বলছে, কোনো পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি সদর দপ্তরে অভিযোগ আসে তাহলে সেগুলো আমলে নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশের নামে ফৌজদারি মামলায় প্রায় প্রতিবছর অনেকেই চাকরি হারাচ্ছেন।
পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সালে ফৌজদারি অপরাধের কারণে চাকরি হারিয়েছেন পুলিশের ৩ জন, ২০১০ সালে ৪ জন, ২০১১ সালে ৩, ২০১২ সালে একজন নারী সদস্যসহ ৬ জন, ২০১৩ সালে ৪ জন, ২০১৪ সালে দুইজন নারী সদস্যসহ ১৩ জন, ২০১৫ সালে ১১ জন, ২০১৬ সালে একজন নারী সদস্যসহ ৩ জন, ২০১৭ সালে দুই জন নারীসহ ৮ জন, ২০১৮ সালে ১১ জন, ২০১৯ সালে ৩৭ জন, ২০২০ সালে ২৭ জন, ২০২১ সালে ৫৮ জন, ২০২২ সালে ৩২ এবং চলতি ২০২৩ সালের ২০ মার্চ পযর্ন্ত ৭ জন ফৌজদারি অপরাধ ও বিভিন্ন কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
জানা যায়, ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় অপরাধ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে আইন প্রয়োগকারী সব সংস্থার। তবে কিছু জটিলতাও রয়েছে।
এদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, পুলিশ কনস্টেবল, উপ-পরিদর্শক ও ওসিদের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তর হয়তো চাকুরি থেকে অবসরে পাঠাতে পারে বা শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে। তবে এর ওপরের কর্মকর্তারা বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অবসরের ব্যবস্থা নিতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নিতে হয়। এক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তর ওসিদের উপরে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ সদর দপ্তরের সুপারিশের ভিত্তিতে তদন্ত করে এবং যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ফৌজদারি অভিযোগে যেসব পুলিশর বিরুদ্ধে রায় হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার রায়ের ফাঁসির রায়ের ঘটনাটি।
এক সময় দুর্দান্ত দাপুটে দাপিয়ে বেড়াতেন টেকনাফের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ। তার বয়েই তটস্থ থাকতো পুরো টেকনাফবাসী। কখন কাকে ক্রসফায়ারের শিকার হতে হয় সেই ভয়ে টেকনাফবাসীর ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। বহু পরিবার তার ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত তিনি ফেঁসে যান সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মেজর সিনহা। দেশ জুড়ে এ ঘটনা তোলপাড় সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় ওসি প্রদীপের নাম উঠে আসে।
ঘটনার পর তৎকালীন সেনাপ্রধান ও পুলিশের মহাপরিদর্শক একসঙ্গে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
সব তদন্তে ওসি প্রদীপের নাম উঠে আসে। প্রথমে তাকে বরখাস্ত করা হয়। পরে গ্রেপ্তার হন। হত্যা মামলা দায়ের হয়। ওই মামলা দায়েরের পর টেকনাফের আরও বহু পরিবার প্রদীপের বিরুদ্ধে থানায় ও আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করে।
সিনহা হত্যা মামলায় কক্সবাজারের আদালত ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল মেজর হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপের ফাসির রায় দেন।
এই রায় ঘোষণার দিন ২শতাধিক পরিবার আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছিলেন। ওসি প্রদীপের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবার প্রদীপ কুমার দাশের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে কক্সবাজারে মানববন্ধন করেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। ওই সময় মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। চট্টগ্রামে ফিরে তিনি পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, তার জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকতে পারেন মামলায় এমনটা অভিযোগ করা হয়। পরে জানা যায় পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার নিজেই তার স্ত্রীকে খুন করেছে।
ওই মামলার দুই আসামি রাশেদ ও নবী পুলিশি হেফাজতে থাকাবস্তায় ২০১৬ সালের ৫ জুলাই চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়কের ঠাণ্ডাছড়ি নামক এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। এই বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে গণমাধ্যম সন্দেহ প্রকাশ করে। গোয়েন্দারা এর সঙ্গে এসপি বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পায় এবং তারা বাবুলকে অভিযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে বের হয়ে আসে মিতু হত্যার বাবুলের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি। বর্তমানে বাবুল আক্তার কারাগারে আছেন । তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়েছে।
এ রকম বহু অপরাধের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠে আসছে বিভিন্ন সময়ে। তবে, পুলিশের বিরুদ্ধে যত ধরনের অপরাধ ও হয়রানির অভিযোগ আসে, তা নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই মামলা করতে চান না ভুক্তভোগীরা। কেউ মামলা করতে চাইলে মামলা না নেওয়া এবং মামলা হলে তদন্তে অবহেলা ও প্রভাব বিস্তারেরও অভিযোগ উঠে। এ কারণে অনেকেই ঝুঁকি নিতে চায় না।
অবশ্য, পুলিশের এমন অপরাধের ঘটনায় অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশসহ বিশেষায়িত বিভিন্ন বাহিনীকে ব্যবহার করার কারণে পুলিশের সদস্যরা নিজেরাই ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে নতুন নয়। ফৌজদারি এমন অপরাধের কারণে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা চাকরিও হারাচ্ছেন। তবে এমন অপরাধ থেমে নেই, বর্তমানে বেড়েছে অনেক গুণ। মূলত দায়িত্বে অবহেলা, অর্থনৈতিক লাভ এবং সামাজিক প্রতিপত্তির চাহিদা থেকেই প্রধানত অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন তারা। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা রাখলে বা সাধারণ মানুষের অভিযোগ গুলো আমলে নিয়ে পুলিশ বিচার করলে এসব অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, পুলিশের দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিভিন্ন অপরাধ প্রতিরোধ এবং বাহিনীতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে আমি অনেক কাজ করেছি। তারপরও পুলিশ একটি বড় সংস্থা যার কারণে কিছু ঘটনা ঘটে। তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ জমা হয়, তারা বিভিন্ন ফোজদারি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। পুলিশের মধ্যে তথ্য প্রমাণের প্রেক্ষিতে এসব অপরাধের বিচার করে পুলিশ যার কারণে অনেকে চাকুরি হারায়।
পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, কোনো থানা বা পুলিশ ফাঁড়িতে যখন অপরাধের অভিযোগ ওঠে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সে অভিযোগ যাচাই করে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। সেই কাজটি যথাযথভাবে হয় না। এ কারণে অনেক সময়ই সেটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাৎক্ষণিক সেটি করা গেলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমে আসবে। তবে সেজন্য পুলিশ বাহিনীতে যোগ্য লোকের নিয়োগ পাওয়া এবং কর্মীদের তদারকি ঠিকমত করার দিকে নজর দিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান বলেন, পুলিশের যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা তদন্ত করা হয় এবং সেটা সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখে শাস্তির সুপারিশ করে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া থেকে শুরু করে ফৌজদারি মামলাও করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে পুলিশের সব পর্যায়ের সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এনএইচবি/এমএমএ/