গুলিস্তান বিস্ফোরণ: কাটছে না ধোঁয়াশা
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে দুই দিনের ব্যবধানে দুটি বিস্ফোরণের ঘটনার পর রাজধানী জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একরকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। কখন কোথায় বিস্ফোরণ হয় তা নিয়েই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক।
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব ও গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ৩০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সিদ্দিকবাজারের ঘটনায়ই প্রাণ গেছে ২৫ জনের। আরও অনেকে এখনো বাঁচার জন্য লড়ছেন।
দুটি বিস্ফোরণের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ফায়ার সার্ভিসসহ প্রায় সবাই বলছেন বিস্ফোরণের কারণ জমাটবদ্ধ গ্যাস। আর তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছে, সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণের ঘটনা গ্যাস লাইন থেকে ঘটেনি।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণ, ঢাকার সাইন্স ল্যাব ও গুলিস্তানের বিস্ফোরণ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন। এসব ঘটনার পেছনে কারা দায়ী তা খুঁজে বের দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্টরা ও সাধারণ মানুষ যদি এসব বিষয়ে সতর্ক না হয় তাহলে এটি থামানোর উপায় দেখা যাচ্ছে না।
তারা বলছেন, ভবনে বিস্ফোরণের তীব্রতা ও হতাহতের ঘটনায় তারা বিস্মিত ও হতভম্ব। ঢাকা শহরে কিছুদিন পরপর আগুন ও ভবন ধসে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে এটি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। তা ছাড়া, সম্প্রতি ২টি ভবনে একই ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনার পর রাজধানীকে বসবাসের উপযুক্ত মনে করছেন না সাধারণ মানুষ।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবাদী স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেছেন, রাজধানীর মাটির নিচ ও ভবনগুলো যেন এখন টাইম বোমায় রূপান্তরিত হয়েছে। ঢাকায় ভূমিকম্প হয় তাহলে আমাদের রক্ষা নাই। মাটির কোনো পাশ দিয়ে তিতাস গ্যাস লাইন নিয়েছে সেটা তারা জানেন না। এমনকি তারা গ্যাসলাইনের নকশা হারিয়ে ফেলেছেন। আগে থেকে যদি আমরা এসব বিষয়ে সতর্ক না হই তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো না, যেকোনো সময় আমরা দুর্যোগের শিকার হতে পারি।
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, ঢাকা এখন খুব বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। গ্যাসরলাইন সংস্কারেও নেওয়া হয়নি যথাযথ উদ্যোগ। যদি সেগুলোতে বিস্ফোরণ হয়, তবে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশের মানুষ।
অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সাবেক কর্মকর্তা একেএম শাকিল নেওয়াজ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, অনেক সময় গ্যাসলাইনগুলো লিক করলে মাটির বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে সেই গ্যাস পানি বা পয়নিষ্কাশন লাইনে মিশে যেতে পারে। সেই পাইপের গ্যাস বেয়ে যায় বহুতল ভবনে। সেখানে যদি পরিবেশ আবদ্ধ থাকে, তাহলে যেকোনো সময় গ্যাস জমতে জমতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। যেটা হয়তো সাইন্স ল্যাব গুলিস্তান বা অন্যান্য জায়গায় ঘটছে।
তিনি বলেন, ‘তা ছাড়া, সাধারণত কোনো ঘরে বা জায়গায় যদি গ্যাসের মাত্রা ৫ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশ থাকে তাহলে কোনোভাবে আগুনের স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটে। এমনকি এসব বিস্ফোরণ দেশলাই, জ্বলন্ত সিগারেট, লাইট-ফ্যানের সুইচের সামান্য স্পার্ক থেকেও হতে পারে। এজন্য বিস্ফোরণের ঘটনা মোকাবিলায় সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো পযর্বেক্ষণের পর পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল বলছেন, বেশির ভাগ জমে থাকা গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ হচ্ছে। আবার কিছু কিছু সময় এসি বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটছে।
গুলিস্তান ও সাইন্স ল্যাবের এই ঘটনার আগে ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারের একটি ৩ তলা ভবনের নিচতলায় জমে থাকা গ্যাস থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। তবে তদন্তকারী সংস্থাদের এমন বক্তব্যের পর জানা যায় ওই ঘটনায় ভবনের নিচতলায় কোনো গ্যাস সংযোগ পাওয়া যায়নি, বরং গ্যাসের সিলিন্ডারও অক্ষত ছিল। অবশ্য মগবাজারের ঘটনায় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, সেখানে মিথেন গ্যাসের গন্ধ ছিল, যা পয়ঃনিষ্কাশন লাইন থেকে লিক হতে পারে।
জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সবার সচেতনতা ও সতর্কতা জরুরি বলে মনে করেন গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোকে তৎপরতা বাড়াতে হবে। সংস্থার সদস্যদের, বিশেষ করে সেপটিক ট্যাংক, এসি, গ্যাসের লাইন, গাড়ি ও বাসার সিএনজি সিলিন্ডার, কারখানার বয়লার ও রাসয়নিক গুদাম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্তৃপক্ষকে মনোযোগী হতে হবে। এসব বিষয়ে সর্তক না হলে ঘটতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি আলাদা হলেও ঢাকার সায়েন্সল্যাব, গুলিস্থান এবং ২০২১ সালে মগবাজারের দুর্ঘটনাগুলো একই প্রকৃতির। যেখানে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় কনফাইন্ড স্পেস এক্সপ্লোশন। বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে বাতাসের সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ মিক্সার তৈরি করলে এ ধরনের বিস্ফোরণ হয়। তবে সায়েন্স ল্যাবের কাছে ভবনটিতে বিস্ফোরণ হয়েছিল তিনতলায়। ফলে চাপে দেওয়াল ভেঙে সহজে প্রশমিত হয়েছে। আর সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল ভবনের বেজমেন্টে হওয়ায় নিচে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যাতে ভবনের সিঁড়িঘর, বেজমেন্ট, ছাদ ভেঙে উড়ে এসে পাশের দেওয়াল এবং উপর তলার কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভবনের কলামগুলো বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে পুরো ভবন ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া) মো. শাহজাহান শিকদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গুলিস্তান ও সাইন্স ল্যাবের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে। তীব্র গতিতে বিস্ফোরণ হওয়ার কারণে ভবন ধসে পড়ে।
তিনি বলেন, এসব ঘটনা আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি সচেতনতার অভাবে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। মানুষ যদি সতর্ক না হয় তাহলে এসব ঘটনা ঠেকানো সম্ভব নয়।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিটের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সচেতনতা ও সতর্কতা। বিশেষ করে ভবনের মাটির নিচে অবস্থিত পানির ট্যাংক, সেপটিক ট্যাংক, গ্যাসলাইন বা সংযোগ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।
বুয়েটের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মো. আশিকুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা পযর্বেক্ষণ করে বলা যায়, মানুষের মধ্যে সতর্কতার অভাব রয়েছে সেই সঙ্গে তিতাস গ্যাস রাজউক বা সরকারের অন্যান্য সংস্থারও গাফিলতি রয়েছে। যার কারণে এসব ঘটনার দায় তারাও এড়াতে পারে না। এসব দুর্ঘটনা রোধে গ্যাসের লাইন ও সিলিন্ডার মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। তাহলে এসব ঘটনা অনেকটা কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, আমার পরামর্শ হচ্ছে তিতাস গ্যাস কতৃপক্ষকে সতর্ক হতে হবে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
অবশ্য তিতাস গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক (কোম্পানি সচিব) মো. লুৎফুল হায়দার মাসুম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গুলিস্তানে আমরা নিচ তলায় দেখেছি সেখানে গ্যাসের কোনো আলামত পাইনি। এজন্য আমরা বলেছি গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটেনি।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য সংস্থা বলছে, গ্যাস থেকেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তদন্তে যেটা পেয়েছি সেটাই তো বলব। আজ আমরা একটা তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছি। বিভিন্ন ঘটনায় আমাদের তদন্তের কাজ এখনো চলমান। তা ছাড়া, আশেপাশের কোনো কিছু থেকে হয়তো গ্যাস আসতে পারে। অথবা পাশের কোনো লাইন থেকে গ্যাস বের হয়ে জমা হতে পারে এবং সেখান থেকেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে গ্যাস থেকে হয়নি।
জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণ গ্যাসের লাইন থেকে হয়নি। ঘটনার এখনো ফাইনাল তদন্ত চলছে।
প্রকৌশলী মো. সেলিম বলেন, ভবনটিতে আমাদের একটি রাইজার পেয়েছি। কিন্তু রাইজারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, অক্ষতই রয়েছে। এ ছাড়া, গ্যাস ডিটেক্টর মেশিনে যে আলামত পাওয়া গেছে, তাতে বিস্ফোরণ হওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়নি। জিরো রেটিং পাওয়া গেছে। তাই প্রাথমিকভাবে তিতাস গ্যাসের পক্ষ থেকে আমরা বলতে পারি বিস্ফোরণটি গ্যাস লাইন থেকে হয়নি।
এনএইচবি/এমএমএ/