জমতে শুরু করেছে নির্বাচনী কূটনীতি
নির্বাচনের আর এক বছরেরও কম সময় বাকি। এরই মধ্যে জমতে শুরু করেছে নির্বাচনকেন্দ্রিক কূটনীতি। একের পর এক কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফরে আসছেন এবং নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয় সেই আহ্বান জানাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যেহেতু ভূরাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই বিশ্বের বৃহৎ পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিও পর্যবেক্ষণ করে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফর করে নির্বাচন নিয়ে তাদের ‘পরামর্শ’ দিচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যের ইন্দো প্যাসিফিক বিষয়ক মন্ত্রী অ্যান-মারি ট্রিভেলিয়ান ৪ দিনের সফরে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। রবিবার (১২ মার্চ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি।
সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ই ব্রিটিশ মন্ত্রীকে বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ব্রিটিশ মন্ত্রী রাজনৈতিক মামলা বন্ধ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোত্রা। সফরকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব।
একই সময়ে অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার ডেরেক শোলে। এসময় গণভবনে সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেরেক শোলেকে বলেন, গণতন্ত্রের জন্য সারা জীবন লড়াই করেছি। নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে আমার দল দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কখনো ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না।
এর আগে আসেন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। তাদেরকেও সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে।
সবচেয়ে আলাচিত সফর ছিল চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংয়ের সফর। যদিও এটিকে তারা সফর নয়, ‘যাত্রাবিরতি’ হিসেবে দাবি করছেন। গত ১৪ জানুয়ারি রাত ১টা ৫৮ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিমানবন্দরেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠক শেষে রাত ২টা ৫০ মিনিটে ঢাকা ত্যাগ করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এই বৈঠক নিয়ে ঢাকা বা বেইজিং কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রথা অনুযায়ী চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার কার্যকাল শুরু করেন আফ্রিকা সফর দিয়ে। কিন্তু নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে তার কার্যকাল শুরু করলেন।
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক র্যাপোটিয়ার ফেলিপ গঞ্জালেসসহ জাপান, ফ্রান্স, ইইউসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করছেন। সবাইকেই সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে।
গত দুই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি ইইউ। এবারও ইউরোপের ২৭ দেশের এই সংগঠনটি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকারকে চিঠি লিখে জানিয়েছে, তারা আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চায়। তবে যদি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হয় তাহলে এবারও পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে চিঠিতে জানিয়েছে সংগঠনটি।
টানাপোড়েন
নির্বাচন নিয়ে কথা বলায় বিদেশি কূটনীতিকদের প্রতি নানা সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। তারা বিষয়টিকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে অভিযোগ করছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে বিদেশিদের কথা না বললেও চলবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ সে বিষয়টিও তিনি বিদেশি কূটনীতিকদের মনে রাখতে পরামর্শ দেন। বিদেশি হস্তক্ষেপ চললে ‘প্রয়োজনে ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথাও বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে এর আগে বলেন, বন্ধুত্বটা নষ্ট করবেন না। আমরা আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই।
বিএনপির কূটনীতিও নির্বাচন ঘিরেই
নির্বাচনের বছরে বিএনপিও বসে নেই। তাদের কূটনীতিও চলছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। বিভিন্ন সময় বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দলটি বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে দলটি কূটনীতিকদের বলেছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে তারা যাবে না। যুক্তি হিসেবে অতীতের দুটি নির্বাচনে ‘অনিয়মের’ কথা বলেছে দলটি।
রবিবারও (১২ মার্চ) ইইউয়ের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে যে শঙ্কা, বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বৈঠকে ইইউয়ের পক্ষে ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ডেনমার্ক, স্পেন এবং সুইডেনের রাষ্ট্রদূত ও উপ-রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, বিভিন্নভাবে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে দলটি। যেহেতু দলটি সংসদে নাই তাই তাদের প্রটোকলের বাইরে গিয়েই যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশি কূটনীতিকরাও নানাভাবে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
এ ব্যাপারে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির আন্দোলনে যে চাপ তৈরি হয়েছে, নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের উপর তার চেয়েও বেশি চাপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আছে। যদিও এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, জনগণের কাছ থেকে সাড়া পাবে না বলেই বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে।
‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ নিয়ে নানা মত
নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা হস্তক্ষেপ করলে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেও রাজনীতিবিদদের কারণেই এসব হস্তক্ষেপ সম্ভব হচ্ছে বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা তাদের কাছে যান এবং তাদের সালিশ মানেন বলেই তারাও আমাদের বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান।
বিদেশিদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক নানা বৈঠকে অংশগ্রহণ করছে। এভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না বলেও মনে করেন তারা।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এম আতিকুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজনীতিবিদরাই বিদেশিদের এমন সুযোগ করে দিচ্ছেন। আমাদের গর্ব করার মতো একটা জিনিস হলো আমদের স্বাধীনতা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। অথচ রাজনীতিবিদরা বারবার বিদেশি দূতদের কাছে ধরনা দেন। একটা কথা বলে রাখি বিদেশিরা কিছুই করতে পারবে না। রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে যে জনগণ তাদের ভোট দেবে। তাই এই বিষয়টির উপর তাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা কেন বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেন না? কেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে অনুসরণ করেন না? কেন মহাত্মা গান্ধীকে অনুসরণ করেন না? কেন আমাদের রাজনীতিবিদরা বিদেশিদের কাছে যান? এখানে তো আত্মমর্যাদার কিছু নাই। বরং মাথা নোয়ানোর ব্যাপার আছে।
নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, আমার ৩০ বছরের কূটনৈতিক জীবনে কখনো আামি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিনি। তারাও আমাদের কাছে কখনো আসেননি। আমাদের লক্ষ্য ছিল দু’দেশের মধ্যে, দু’দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন। কিন্তু এখানে যেটা দেখছি সেটা লজ্জার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বিবাদের বিষয় তো আছেই। আমরা যদি তাদের কাছে যাই তাহলে তারা তো তাদের কথা বলবেই। এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা তাদের কাছে যাই, তাদের সালিশ মানি। তাই তারাও তাদের কথা বলে।
এক প্রশ্নের জবাবে শান্তনু মজুমদার বলেন, তবে এত সরলীকরণ করলেও হবে না। কারণ শক্তিশালী দেশগুলোর উপর আমাদের মতো দুর্বল দেশ নানাভাবে নির্ভরশীল। তার মধ্যে বাজার একটা ব্যপার। এ ছাড়া ভূরাজনীতির কিছু ব্যাপার থাকে। এটাও একটা কারণ তাদের আমাদের বিষয়ে কথা বলার।
এনএইচবি/এসজি