প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা: উত্তরণের পথ (২)
স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
ঢাকাপ্রকাশ
অক্ষরের পাশে অক্ষর বসানো সমাচার দর্পণ থেকে আজকের ঝকঝকে চার রঙে ছাপা প্রতিদিনের অজস্র সংবাদপত্র। সাদা-কালো যুগ পেরিয়ে স্যাটেলাইটের হাত ধরে দেশ-মহাদেশের সীমানা পেরিয়ে যায় টেলিভিশন। এককালের ছুটে চলা প্রান্তিক সাংবাদিকতা থেকে আজকের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ। সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রযুক্তির নানা মাত্রা।
এত কথা যে সংবাদমাধ্যম নিয়ে, বর্তমানে তার গতিপথ কোন দিকে? মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে নতুন শতকের প্রথম দুই দশক পেরিয়ে আজ কোন জায়গায় আমাদের সাংবাদিকতা? তার মানই বা কী?
প্রশ্ন অনেক, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি আমরা। ঠিক সে কারণেই ঢাকা প্রকাশের পক্ষ থেকে মুখোমুখি হওয়া গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের।
বর্তমান সাংবাদিকতার নানা সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
গণমাধ্যম জনগণের মাধ্যম। জনগণের সঙ্গে সরকারের সেতুবন্ধন। এর মাধ্যমে সমাজের সঠিক অবস্থান এবং জনগণ কী চায়–সেটি যেমন সরকার জানতে পারে, ঠিক তেমনি জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে তার মতামতও প্রকাশ করতে পারে।
দায়িত্বশীল ও সৎ সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি বস্তুনিষ্ঠতা। গণমাধ্যমে যদি বস্তুনিষ্ঠতা না থাকে, তাহলে গণমাধ্যমের আর কোনো অর্থ থাকে না। তবে সরকারি নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারার অপব্যবহার, গণমাধ্যম মালিকদের চাপ এবং সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবসহ নানা সমস্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতা। সেই সঙ্গে রয়েছে সাংবাদিকদের বিভক্তি ও নিষ্ক্রিয়তা।
স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশকিছু ধারাকেই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করছেন সাংবাদিক, গণমাধ্যম বিষেশজ্ঞ ও গবেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘একজন সাংবাদিক সৎ থেকে সাংবাদিকতা করলে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা হওয়ার কথা নয়। অথচ আমরা দেখি, অনেক সাংবাদিক এ আইনের ভুক্তভোগী হচ্ছেন। এটি আমরা দেখতে চাই না। বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেন কোনো বাধা না হয়, সেদিকে সরকারের নজর দেওয়া দরকার।’
ডিজিটাল নিরাপত্তার অপব্যবহারের বিষয়ে সাহিত্যিক ও অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন জায়গায় ওঁৎ পেতে থাকা দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে সংবাদ করলে, তাদের কিছুই হয় না। কিন্তু যারা এটা প্রকাশ করছেন তাদের নিগৃহীত হতে হয়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, “ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘শুটিং দ্য মেসেঞ্জার’। বার্তাবাহককে মেরে ফেললে তো বার্তার কোনো হেরফের হচ্ছে না। আসলে বার্তাটাকে দেখতে হবে।”
তবে সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা থাকা উচিৎ বলেও মনে করেন এ গবেষক ও সাহিত্যিক।
তিনি বলেন, ‘মুক্ত সাংবাদিকতা কখনো ছিল না। সেটা হবে বলে আশা করাও ভুল। তবে সাংবাদিকদের কিছু প্রতিবন্ধকতাও থাকা উচিৎ। তাদের কিছুটা প্রতিবন্ধকতা না থাকলে, তারা প্রতিবাদি হন না। জনগণের কণ্ঠকে ধারণ করেন না।’
বর্তমানে ভিন্নমত প্রচার-প্রকাশও কঠিন আবার কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরাও কঠিন হয়ে পড়েছে। যথাযথ বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ না করেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডিবিসি নিউজের সম্পাদক ও গণমাধ্যম গবেষক জায়েদুল আহসান পিন্টু।
তিনি বলেন, এ আইনের কিছু কিছু ধারায় প্রশাসনকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যেমন–বিনা ওয়ারেন্ট অ্যারেস্ট করবে, জাজমেন্ট দেওয়ার আগেই কন্টেন্ট সরিয়ে দেবে, কথা বলতে গেলেই কথার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে পারে। কোন কথার কী ব্যাখ্যা করবে, তার সিদ্ধান্ত দেবে একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর!’
‘কোনটা শ্লীল, কোনটা অশ্লীল, কোনটা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করবে, কোনটা তৈরি করবে না–এসবের সংজ্ঞা নির্ধারণ না করেই এ আইন পাস করে ফেলল। যারা প্রকৃত অপরাধী বা অভিযুক্ত হতে পারে, তাদের চেয়ে নিরাপরাধ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। এ আশঙ্কা আমাদের ২০১৮ সালেও ছিল, এখনো পরিপূর্ণভাবে রয়ে গেছে‘–যোগ করেন ডিবিসি সম্পাদক।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি বলে মনে হচ্ছে সেগুলো বাতিল বা সংশোধনের জন্য সাংবাদিকরা কী ভূমিকা পালন করেছেন–এমন প্রশ্নের জবাবে এ গণমাধ্যম গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, ‘আমারাও রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত। সে জায়গাটায় আমরা এক হতে পারছি না। ২০১৮ সালে একই দিনে সংসদে সড়ক পরিবহন আইন পাস হলে, দেশের স্টেকহোল্ডাররা সবাই সমর্থন দিলেন। কিন্তু শ্রমকি-মালিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আইনটি রুখে দিলেন। কিন্তু আমরা পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের উচিৎ ছিল প্রফেশনাল চিন্তা করে এ আইনের কোন কোন ধারার অপব্যবহার হতে পারে বা হচ্ছে, যেগুলোর সংশোধন দরকার, সে বিষয়ে সবাই এক হয়ে সরকারের সঙ্গে বসা।’
সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলে প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ভিন্নতা। এ ছাড়া সাংবাদিকদের মধ্যেও ছোট প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন পত্রিকার জেলা প্রতিনিধিরা নির্যাতনের শিকার হলে খুব জোরাল প্রতিবাদ দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘এটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। এটা হওয়া উচিৎ ছিল না। আমরা যদি প্রফেশনালি (পেশাগত) ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগুলো ডিল করতাম, প্রতিবাদটা একই রকম হতো। এটি সাংবাদিকতার একটি বিচ্যুতি।’
এসব সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বকে উন্নত করার পরামর্শ দেন তিনি। সাংবাদিক নেতাদের শুধু রুটি-রুজি নয়, সাংবাদিকতার মান উন্নয়ন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই তাদের ভূমিকা রাখতে হবে বলেও মন্তব্য করেন এ গণমাধ্যম গবেষক।
শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা নয়, সরকারের বিভিন্ন বাহিনী থেকেও চাপ আসে বলে জানান জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘এক সময় সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ আসত, এখন আদেশ হিসেবে আসে। সরাসরি বলে না এটা করবেন না, কিন্তু এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়, যাতে আপনি নিজেই এটা করতে চাইবেন না।’
এ গণমাধ্যম গবেষক বলেন, ‘আইন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া মিডিয়ার মালিকেরা সরকারের লোক। পত্রিকার লোকগুলো সরকারের লোক নাহলেও সরকারের সঙ্গে একটা আন্ডাস্ট্যান্ডিংয়ের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়। যারা চলে না তাদের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি হয়। তবে এর মধ্যে দিয়েও সাংবাদিকরা তার কাজ বের করে নিচ্ছেন। আমি যে কথাগুলো বললাম, সে পরিবেশ যদি থাকত, তাহলে হয়তো ১০০ ভাগ মুক্ত গণমাধ্যম হতো। সেটার জন্য আরো লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে।’
সাংবাদিকদের আইনি সুরক্ষা দিতে না পারলে স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে অনেকে নানা ধরনের অপপ্রচার করছে। এসব থেকে মুক্তি পেতে হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এ আইনের কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
এক্ষেত্রে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন সাংবাদিকতার এ অধ্যাপক।
তিনি বলেন, ‘এ আইনের আওতায় কোনো সাংবাদিকের নামে যদি অভিযোগ ওঠে, তাহলে তা সঠিক কি না, সেটি দেখার জন্য সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। যেমন–সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেস কাউন্সিল, রিপোর্টারস ইউনিটি। দায়িত্বশীল সংগঠন থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেই সাংবাদিককে অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’
সাংবাদিকদের সুরক্ষার বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া মালিকদের স্বার্থ রক্ষার কাজ করে। এমন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রতিষ্ঠান নিজেই চলতে পারে। এ ছাড়া সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। মালিকসহ গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সবার জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমেই মনিটর করতে হবে। নিজস্ব ব্যবসায়িক মডেলসহ বিশেষায়িত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
দায়িত্বশীল ও সৎ সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘উন্নত দেশ চাইলে, উন্নত সাংবাদিতকতা থাকতে হবে। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা চাইলে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে হবে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা যে পর্যায়ে যাওয়া উচিৎ ছিল, সেখানে পৌঁছাতে পারেনি।’
এসএন/এসএ/