আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে সংঘাতের শঙ্কা
সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দল বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে রাজনীতির মাঠ বেশ উত্তপ্ত। যদিও এখন পর্যন্ত কোথাও কোনোরকম সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তবে ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপির সরকারবিরোধী পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রাজধানী ঢাকা বা বিভাগীয় শহরগুলোতে সহিংসতার ঘটনা না ঘটলেও এখন ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো দুই বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এমন কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের মনে নানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অবশ্য দুই রাজনৈতিক দলের নেতারাই বলছেন, কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে হবে। সহিংসতার কোনো আশঙ্কা নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, আমরা শান্তি সমাবেশ করব। যদি কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করে তাহলে জবাব দেওয়া হবে।
অন্যদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছি। এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে কোনো বাধা আসলে তার জবাব দেওয়া হবে।
অপরদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি হলে সহিংসতা-সংঘাতের সম্ভাবনা থাকে।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওইদিন রাজধানীতে সমাবেশ করবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। সমাবেশে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া বাকি ৭৬টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪০টিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেতাদের নিজ জেলায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কোনো কর্মসূচি রাখা হয়নি। ওই দিন ইউনিয়ন পর্যায়ের পদযাত্রা কর্মসূচি সফল করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন। বিশেষ করে নেতারা নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করবেন।
সরকার পতনের দাবিতে এবং নিরপেক্ষ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি গত কয়েক মাস ধরে সারা দেশে সভা-সমাবেশ করে আসছে। সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা সমাবেশকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয়। বিএনপির একাধিক নেতা দাবি করেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে। বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যে নড়েচড়ে বসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারাও ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের দিন রাজধানীর মোড়ে মোড়ে পাহাড়া বসানোর ঘোষণা দেয়। দুই দলের কর্মসূচিতে রাজধানীতে উত্তাপ ছড়ালেও কোনোরকম সহিংসতা ছাড়াই বিএনপির সমাবেশ এবং আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ওই কর্মসূচি শেষ করেন। তারপর থেকেই বিএনপির প্রত্যেক কর্মসূচির দিনেই আওয়ামী লীগও কোনো না কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং দলটির নেতা-কর্মীরাও মাঠে সক্রিয় থাকেন।
গত ২৮, ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি এবং ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিএনপির পদযাত্রা ঘোষণা করলে ওই দিনগুলোতেও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল আওয়ামী লীগ। গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি ঢাকাসহ দেশের ১০টা বড় শহরে সমাবেশ ডাকলে আওয়ামী লীগও পাল্টা শান্তি সমাবেশ করে। কোনোরকম সহিংসতা সংঘাত ছাড়াই এসব কর্মসূচি শেষ হয়েছে।
এবার বিএনপি ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিএনপির এই কর্মসূচির বিপরীতে আওয়ামী লীগ একই দিনে সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়েছে। বড় দুই রাজনৈতিক দলের এই কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই কর্মসূচির দিনে দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাত ছড়াতে পারে।
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকট কামরুল ইসলাম বুধবার রাতে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা কারও সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য সমাবেশ করব না। তবে কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করলে আমরা বসেও থাকব না। সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বুধবার রাতে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা মনে করি, কোনোরকম সহিংসতা বা সংঘাত হবে না। আমাদের সমাবেশের নামই শান্তি সমাবেশ। আমরা কোনো উসকানিতে পা দেব না।’
তিনি বলেন, ‘তবে বিএনপি কর্মসূচির নামে তামাশা সৃষ্টি করেছে। তারা বলে ১০ ডিসেম্বর থেকে খালেদা জিয়ার নির্দেশ দেশ চলবে, এরকম আরও কত কী। তারা যদি কর্মসূচির নামে মানুষের জানমালের ক্ষতি করে তাহলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তার জবাব দেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদক আরও বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়েই মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।’
অপরদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার পতনের দাবিতে এবার তারা ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি দিয়েছেন। চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবেই আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রার কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা বলছেন, গত ২২ আগস্ট থেকে তৃণমূলে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। ১২ অক্টোবর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছে। সর্বশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে একসঙ্গে বিভাগীয় সমাবেশ করেছে বিএনপি। এসব কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আন্দোলন শুরু হওয়ার মহড়া চলছে। এতেই সরকারের ভীত নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখন আমরা সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি দিয়েছি। এই কর্মসূচিতে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া হবে। আগে বিভাগীয় সমাবেশ করেছি, জনগণের কাছে গিয়েছি। ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সৃষ্ট আন্দোলনেই এই সরকারের পতন ঘটনো হবে।’
তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি এটিই মূলত সরকার পতন আন্দোলনের রোডম্যাপ। যা ধাপে ধাপে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও জোট একইদিন পৃথকভাবে পালন করবে। জনশক্তির বিরুদ্ধে কোনো অপশক্তি থাকতে পারে না। বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাধারণ জনগণের উপস্থিতি তা প্রমাণ করেছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে শাহজাহানপুরে নিজের বাসায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক প্রস্তুতি সভায় আওয়ামী লীগকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, পাল্টা কর্মসূচির জবাব কীভাবে দিতে হয় সেটা শিগগির দেখতে পাবেন।
তিনি বলেন, ‘শান্তি মিটিংয়ের নামে অশান্তি সভা করবেন না, বিএনপি কর্মসূচি দিলে পাল্টা কর্মসূচি দেবেন না। প্রয়োজন হলে আগে কর্মসূচি দেবেন। আমরা আপনাদের দিনে কর্মসূচি দেব না। যদি শান্তি চান বিএনপির কর্মসূচির দিন কর্মসূচি দিবেন না। অশান্তির জবাব কীভাবে দিতে হয় সেটা শিগগির দেখতে পাবেন।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘দেশের সব মহানগরের সাংগঠনিক শক্তি দেখতে ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। ঢাকা মহানগরে চার দিনের পদযাত্রাসহ অন্যান্য মহানগরেরও বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীরা উপস্থিতি ছিল। যা নিয়ে সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এখন দলটির চোখ তৃণমূলে। সেখানে ধাপে ধাপে কর্মসূচি পালন করে সাংগঠনিক শক্তি প্রমাণ করতে চায়। এরপর কেন্দ্রীয়ভাবে চূড়ান্ত কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায় করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য।’
তিনি বলেন, ‘অতীতের মতো এবারও আমরা সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে চাই। ইতোমধ্যে আমাদের মহাসচিব একইদিনে আওয়ামী লীগকে কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে কর্মসূচিতে কিছুটা কৌশল নেওয়া হয়েছে। আন্দোলন আরও জোরদার করতে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রার কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। ধাপে ধাপে উপজেলা ও জেলায় কর্মসূচি দেওয়া হবে। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় পর্যায়ে চূড়ান্ত কর্মসূচি দেওয়ার আগ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আরও কাছে যেতে চায় বিএনপি।’
অপরদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আনু মুহম্মদ বুধবার রাতে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিতে এক ধরনের অজানা সংঘাত সহিংসতার সম্ভাবনা থাকে। সে ক্ষেত্রে যদি প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে একইদিনে মাঠে নামে তাহলে তো সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সহিংসতা সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকেই যায়। এতে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
এসজি