আসন্ন সংসদ নির্বাচন
নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়তে পারেনি ইসলামী দলগুলো
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যেই অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই এখন নির্বাচনমুখী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বেশকয়েকটি জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। জাতীয় পার্টিও ব্যস্ত দল গোছানোর কাজে। ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করছে দলটি।
অন্যদিকে, সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় সরকার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তবে তারা নির্বাচনের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের পুরনো শরীক ১৪ দলীয় জোটকে নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করার চেষ্টা করছে।
নির্বাচনী এই আগাম ডামাঢোলে যেন পিছিয়ে আছে দেশের ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো ঐক্য গড়ে উঠেনি। এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন কিংবা নির্বাচন করা নিয়ে তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন একাধিক ইসলামী দলের নেতা।
অপরদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই চাচ্ছে ইসলামী দলগুলোকে নিজেদের দিকে ভেড়াতে। উভয় দলের নেতারা চাচ্ছেন ইসলামী দলগুলোর সমর্থন আদায়ে ছাড় দিয়ে হলেও নিজেদের দিকে নেওয়ার।
দেশের রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ভোট আছে বা ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে এমন দলগুলোর কদর বাড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির মধ্যে। তবে ইসলামী দলগুলোও নিজেদের তৎপরতা বাড়াচ্ছে। নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে কোনোরকম সিদ্ধান্ত না হলেও নতুন জোট গঠন কিংবা বড় দলগুলোর জোটে যুক্ত হতে আলোচনা শুরু করেছে দলগুলো। পৃথক জোট গড়ারও চেষ্টা করছে কয়েকটি দল।
ইসলামী দলগুলোর নেতারা বলছেন, ইসলামী ধারার রাজনীতি বিপর্যয়ের মুখে। ক্রমেই শেকড়হীন হয়ে পড়ছে। ইসলামী ধারার দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই পীর) ও ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী) দলই ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাদের ব্যর্থতা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা ও বিশ্বাস-অবিশ্বাস। এ কারণে এখন পর্যন্ত ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ একটি প্ল্যাটফর্মে পৌঁছতে পারেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নেতৃত্বের অভাবেই ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর এলোমেলো অবস্থা। এরমধ্যে নির্বাচনে যেতে হলে এখনই নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করা জরুরি। কিন্তু সেটি এখনো হয়ে উঠেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনী মাঠ তৈরিতে প্রতিটি ইসলামী দলকে কিছুটা কৌশলে পথ হাটঁতে হবে।
জানা গেছে, ২০ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে যাওয়া ইসলামী দলগুলো নিজেদের মধ্যে একটি জোট গড়ার চেষ্টা করছে। দলগুলো হলো— বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুর রহমান হেলাল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে ঘিরে এই মুহূর্তে জোটগত কোনো বিষয়ে আলোচনা নেই। নির্বাচন নিয়ে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত হয়নি। আপাতত নিজেদের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত আছি। তবে অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামি ধারার দলের সংখ্যা ১০টি। পাশাপাশি নাম-সর্বস্ব ইসলামি দলও গজিয়ে উঠেছে। এ ছাড়াও ইসলামি দলগুলোর নেতারা সুযোগ-সুবিধার রাজনীতিতে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠায় আলোচনা-সমালোচনা আছে।
ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে ২০১৩ সালে মাঠে নেমেছিল হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু অরাজনৈতিক এই সংগঠনটির নেতারা আদর্শের চেয়ে সুবিধার পেছনে হেঁটে কখনো সরকারের পক্ষে আবার কখনো সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে আগে হেফাজতে ইসলামীর উপর কিছুটা বিশ্বাস থাকলেও বতর্মানে দেশের সাধারণ মানুষ তাদের আর বিশ্বাস করতে পারছে না।
খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল জলিল ঢাকাপ্রকাশ কে বলেন, খেলাফত মজলিস একটি নির্বাচনমুখী দল। অতীতেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, আগামী নির্বাচনের অংশ নেবে। তবে সেই নির্বাচনের পরিবেশটা কেমন হয় সেটাও দেখার বিষয়। আমরা নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ও নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছি। আমরা ইসলামী ঐক্যের পথে হাটঁছি। নির্বাচন কিংবা জোট কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। ইসলামী দলগুলোকে একটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করাতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারি দল কিংবা বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চেয়ে আপাতত নিজস্ব কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সমাবেশ কর্মসূচি আছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সহকারী মহাসচিব মাওলানা ইমতিয়াজ আলম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা ঐক্যেবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি সমঝোতার ভিত্তিতে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো যেন ঐক্যেবদ্ধ হতে পারি। সমঝোতা মানে হলো আমরা ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে ইসলামী সমঝোতা করতে চাই। জোটবদ্ধ না হলেও অনন্ত সমঝোতা হয়েও যেন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যায়। আমাদের দলের আমির সাহেব ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে ঐক্যেবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা সেই লক্ষ্যে দলের কার্যক্রম অব্যাহত রাখছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজত ইসলামীর একজন দায়িত্বশীল নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজনীতিতে ইসলামী ধারার দলগুলোর বিগত দিনের অতি উৎসাহী কিছু নেতার ভূমিকা নিয়ে জনমনে কিছুটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে সমমনা ইসলামী দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে। কিছুটা বিলম্ব হলেও এবার বোধদয় হয়েছে দলগুলোর নেতাদের। নেতারা বলছেন, ইসলামী দলগুলোর একলা চল নীতির ফল ভালো হয়নি। আর সঙ্গত কারণেই বড় রাজনৈতিক দলগুলো ইসলামী দলগুলোর সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করবে। তাই আগামীতে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী মাঠে নিজেদের জানান দিতে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মা’ছুম বলেন, ‘বর্তমানে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের প্রক্রিয়া চলছে। এর মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হলে আমরা নির্বাচনে যাব। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে।’
এনএইচবি/আরএ/