তারপরও কাটছে না ডলার সংকট
নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও কাটছে না ডলার সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব পরিস্থিতি টালমাটাল হতে শুরু করলে অস্থির হয়ে উঠে ডলারের বাজার। ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে গিয়ে ঠেকে ১০৭ টাকায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে। কিন্তু তাতেও সংকট কাটেনি। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানিতেও হ্রাস টানা হয়। গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে রেকর্ড ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে পৌঁছায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে রেমিট্যান্স বাড়িয়ে এবং আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করেই ডলার সংকট দূর করা হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ কোনো সমাধান নয়। এটা চলতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি জানিয়েছেন, ডলার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে।
এদিকে গত বছর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১১ লাখ বাংলাদেশি গিয়েছেন কর্মসংস্থানের উদ্দেশে। কিন্তু সেই তুলনায় দেশে রেমিট্যান্স আসার পরিমান অনেক কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হুন্ডির কারণে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসছে না। নানরকম ঝামেলার কারণে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা অবৈধ পথে অর্থাৎ ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
রেমিট্যান্স কম আসার কারণে বাধ্য হয়েই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তারপরও ডলার সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সহনীয় মাত্রায় ডলার বিক্রি করতে বললেও বিভিন্ন ব্যাংক বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে। এই সুযোগে ব্যাংকগুলো হাজার কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। এ নিয়ে হইচই পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্নভাবে পরিদর্শন করে ১২টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়।
ডলার সংকটের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, হুন্ডির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক মাস থেকে রেমিট্যান্স কমে যায়। এ জন্য সরকারি আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। গত বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন (১২০০ কোটি) ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
এই সময়ে আমদানি ব্যয়ও প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। আগে প্রতি মাসে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার আমদানিতে ব্যয় হলেও তা কমে সাড়ে চার বিলিয়নে নেমে এসেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী পরিচালক বলেন, দেখেন আমেরিকা ডিপোজিটে (আমানত) ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। কাজেই সবাই ইউএসএ তে চলে যাচ্ছে। তাদের চাহিদাও বাড়ছে। এরফলে ব্রিটেন, শ্রীলঙ্কা. জার্মানিসহ সারা বিশ্বে ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে। তাই আমাদের একমাত্র উপায় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি ব্যয় কমানো। এ জন্য আমরা সেই পথে যাচ্ছি। বিলাসী পণ্যের ব্যবহারে কঠোর হচ্ছি, যাতে ডলারের চাহিদা কমে যায়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ১০০ টাকায় ডলার বিক্রি করছে। রেমিট্যান্সে ১০৭ টাকা ও রপ্তানিতে ১০৩ টাকা দিতে বলা হয়েছে। যাতে প্রবাসীরা বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠায়। হুন্ডি কম হয়।
এদিকে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গত ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও বলেছেন, জুলাই মাসে আমদানি কমাতে আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। বেশি দামে ঋণপত্র যেন খোলা না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। এসব পদক্ষেপের ফলে আমদানি কমেছে। এখন প্রতি মাসে আমদানিতে যে খরচ হচ্ছে, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় তার চেয়ে বেশি। তবে আগের আমদানি দায় এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ জন্য ডলারের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদ বৃদ্ধি ও করোনার ওপর নির্ভর করছে ডলার–সংকট সুরাহার বিষয়টি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, করোনার সময় দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। এরফলে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। এরপর থেকেই রেমিট্যান্স কমতে থাকে। রেমিট্যান্স কম আসায় রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। কারণ সরকারি আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলার বিক্রি করতে থাকায় ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় গত বছরের আগস্টের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে ৩৩ বিলিয়নের কম দাঁড়িয়েছে।
ডলার সংকট কিভাবে দূর হবে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ডলারের দাম ফ্রি করে দিতে হবে। তা না করলে সংকট দূর হবে না। কারণ বর্তমানে ডলারের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আমদানি কমানো বা নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সমাধান নয়। এটা চলতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। বিনিয়োগ কমে যাবে। সামনে নির্বাচন। এ জন্য হুন্ডি বাড়ছে। সরকারের বিভিন্ন দুর্বলতার কারণেই অর্থ পাচার হচ্ছে। বাণিজ্যের নামে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। মানে ডলার চলে যাচ্ছে। এ জন্য ডলার সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এনএইচবি/এএস