চাল-তেল ছাড়া সিটি গ্রুপের চিনি পান না খুচরা বিক্রেতারা!
খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ তীর ব্র্যান্ডের চিনি কিনতে গেলেই বাধ্যতামূলক এক কার্টন তীর সরিষা তেল ও ৭৫ টাকা কেজি দরের ১০ কেজির এক বস্তা চাল নিতে হয়। এ জন্য তারা ডিলার ও বা পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চিনি কিনতে পারছেন না। ফলে খুচরা বাজারেও চিনির সংকট কাটছে না।
শনিবার (১৪ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, কৃষি মার্কেটসহ পাড়া-মহল্লার মুদি দোকান ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে চিনি সংকটের কারণ সম্পর্কে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
চিনির দাম বৃদ্ধি করার পরও বাজারে সহজে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিনির বড় জোগানদার তীর কোম্পানি অর্থাৎ সিটি গ্রুপ। কিন্তু তারা চিনি উৎপাদন করলেও সেই চিনি বাজারে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তীর ব্র্যান্ডের ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতারা সরিষা তেল ও চাল না নিলে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে চিনি বিক্রি করছেন না। শুধু তাই নয় খুচরা বিক্রেতারা আরও অভিযোগ করছেন ডিলার বা পাইকাররা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে প্রতি কেজি চিনি ১০৭ টাকার নিচে বিক্রি করছেন না। অথচ সরকার প্রতি কেজি চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ১০৭ টাকা।
ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে গত ১৭ নভেম্বর প্রতি কেজি প্যাকেট চিনির দাম ৯৫ থেকে ১০৭ টাকা ও খোলা চিনির কেজি ১০২ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। দাম নির্ধারণের পর প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও বাজারে চিনির স্বাভাবিক সরবরাহ নেই। খুচরা বাজারে তীব্র সংকট। এর কারণ জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের সালমান ট্রেডার্সের মো. ফেরদৌস ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, চিনি নেই। কয়েকদিন আগে সিটি গ্রুপের এক বস্তা চিনির সঙ্গে ১০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চাল ৭৮০ টাকা ও এক কার্টন সরিষার তেল ধরিয়ে দেন ডিলার। যেখানে প্রতি লিটার সরিষার তেলের দাম ৩৪০ টাকা ও ৫০০ গ্রামের দাম ১৭০ টাকা। অথচ তাদের তেলের দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা সেটি নিতে চান না। তারপরও সিটি গ্রুপ জোর করে ধরিয়ে দিয়েছে। এ কারণে এখন চিনি রাখি না।
তিনি আরও বলেন, প্রতি কেজি চিনির প্যাকেটের গায়ে মূল্য লেখা ১০৭ টাকা। এটা হচ্ছে খুচরা বিক্রয় মূল্য। অথচ এই দামেই ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে। তারা কোনোভাবেই কম দামে দেয় না। তাহলে আমি কি লাভ ছাড়া ব্যবসা করব? এ জন্য চিনি রাখি না। কারওয়ান বাজার মার্কেটের তৃতীয় তলায় সিটি গ্রুপের ডিলার রয়েছে। তার কাছ থেকেই আমরা পণ্য কিনে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করি।
একই অভিযোগ দিলেন ইয়াসিন স্টোরের মো. আলী ইউসুফ। এই খুচরা বিক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ১০৭ টাকার চিনি ১১০ টাকা ছাড়া পাওয়া যায় না। তাহলে কি দামে বিক্রি করব? আবার বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানা দিতে হয়। তাই চিনি রাখি না। কোম্পানি থেকে ঠিকভাবে সরবরাহ করলে এই সংকট কেটে যাবে।
একই বাজারের লক্ষীপুর স্টোর, ইউসুফ জেনারেল স্টোর, আব্দুর রব স্টোরসহ অনেক খুচরা ব্যবসায়ীদেরও অভিযোগ, প্রতি কেজি চিনির দাম ৯৫ থেকে ১০৭ টাকা করা হলেও সিটি গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানির ডিলাররা শুধু দিব, দিচ্ছি বলেও চিনি দিচ্ছে না। তাই আমরাও বিক্রি করতে পারছি না।
তারা আরও বলেন, চিনির উৎপাদন তো থেমে নেই। তারপরও মিল থেকে চাহিদা মতো চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে এতো চিনি যাচ্ছে কোথায়? এটা সরকারের দেখা দরকার।
মোহাম্মদপুরের কৃষিমার্কেটের সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহের বলেন, ‘কোম্পানির সিন্ডিকেটের কারণে দাম বাড়ার পরও আমরা চিনি পাচ্ছি না। তাই বিক্রি করতে পারছি না। এ জন্য ভোক্তারা চিনি পাচ্ছেন না। এই খুচরা বিক্রেতাসহ অন্যান্য বিক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বেশি দাম না দিলে চিনি পাওয়া যায় না। আবার বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানা দিতে হচ্ছে। তাই চিনি রাখি না। কিছু জানতে হলে সিটিগ্রুপের ডিলারের কাছে যান। তারাই বলতে পারবে।
খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগের সূত্র ধরে কৃষিমার্কেটে সিটি গ্রুপের ডিলার মেসার্স খালেক এন্ড সন্সে যোগাযোগ করা হলে ম্যানেজার মো. সালেক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, চার দিন ধরে চিনি নেই। আগের ডিওতে চিনির সঙ্গে তেল ও চাল আনা হয়েছিলো। তাই বিক্রেতাদের কাছেও একইভাবে বিক্রি করা হয়েছে। কখন চিনি পাওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিও খুলবে রবিবার। তারপর কোম্পানি থেকে দিলে বিক্রি করতে পারব।
ভোক্তা অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের অজুহাতে চাল, ডাল, সাবান, ডিটারজেন্টসহ নিত্যপণ্য বেশি দামে বিক্রি করায় সিটি গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাড়তি দামের কারণও জানতে চাওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে গত সেপ্টেম্বরে ৪৪টি মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এরমধ্যে সিটি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে বেশি দামে চাল বিক্রি করার অপরাধে (২৪/২০২২ নং) এবং আটা-ময়দা বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে (৩৮/২০২২ নং) গত ২৬ সেপ্টেম্বর মামলা করে কমিশন। এরপর শুনানি হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে চিনি, চালসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি অব্যাহত আছে। শুধু তাই নয়, মিনিকেট নামে কোনো চাল না থাকলেও সিটি গ্রুপ মোটা ধান পলিশ করে ‘তীর মিনিকেট’ নামে চাল সবচেয়ে বেশি ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি করছে।
শর্ত জুড়ে পণ্য বিক্রির ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ’প্যাকেজ করে কেউ কোনো পণ্য বিক্রি করতে পারে না। এটা ভোক্তা আইনের লঙ্ঘন। এটা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘চিনি পাওয়া যায় না এটা ফালতু কথা। কার কতো চিনি লাগবে বলেন, আমি দিয়ে দিব। মুষ্টিমেয় কয়েক জন এ ব্যাপারে অভিযোগ করতে পারে।
এনএইচবি/এএস