চাল-আটায় ভোক্তার পকেট কাটা বন্ধ করেনি সিটি গ্রুপ
চাল, ডাল, সাবান, ডিটারজেন্টসহ নিত্যপণ্যে ভোক্তার পকেট কাটা বন্ধ হয়নি। অথচ নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগে সিটি গ্রুপ, ইউনিলিভারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে ভোক্তা অধিদপ্তর। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। তারপরও থেমে নেই ভোক্তাদের পকেট কাটা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের অভিযোগ, আগের লটের পণ্য শেষ না হতেই বেশি দামের পণ্য নিয়ে হাজির হচ্ছে সিটি গ্রুপ। শুধু তাই নয়, মিনিকেট নামে কোনো চাল না থাকলেও সিটি গ্রুপ মোটা ধান পলিশ করে ‘তীর মিনিকেট’ নামে সবচেয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করছে। আটাও বেশি দামে বিক্রি করছে। তাদের চিনিও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। বড় বড় মার্কেট থেকে শুরু করে পাড়া মহাল্লার ছোট ছোট দোকানে সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপার্সন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের অনুসন্ধানেও সিটি গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানি বেশি দামে চাল, আটা, চিনি ও ডিটারজেন্ট বিক্রির সত্যতা পাওয়া গেছে। তাই স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। শুনানির জন্য তাদের ডাকা হয়েছে। তারা জবাবও দিয়েছে। তদন্ত করার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই সিটি গ্রুপসহ অন্যদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলা করার পরও সিটি গ্রুপসহ অন্যরা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে আইনের আওতায় যেটুকু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা করা হবে। তবে এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ অন্য প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আমি ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব।
তিনি বলেন, আসলে মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত আছে কি না তা জানতে চাওয়া হয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়ে। তারা জানিয়েছে মোটা থেকে মাঝারি চিকন, বিআর-২৮, ২৯, জিরাশাইল ও স্বর্ণা জাতের ধান একাধিকবার পলিশ করে চিকন করে তা বস্তার উপর মিনিকেট নামে বেশি দামে বিক্রি করছে। এতে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন। চালের পুষ্টিগুণ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, মিনিকেটের নামে বেশি দামে চাল, আটা ও চিনি বিক্রি করায় সিটি গ্রুপসহ বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তাদের অনিয়ম ধরা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে মিনিকেট আছে কি না তা খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় বলবে। সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। আমার দেখার বিষয় উৎপাদনের পরে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কেউ অতি মুনাফা করছে কি না। যদি ধরা পড়ে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও গত ১৩ সেপ্টেম্বর বলেছেন, ‘দেশে মিনিকেট বলে কোনো চাল নেই। তবু ব্যবসায়ীরা মিনিকেট নামে চাল বাজারজাত করছেন। যারা মিনিকেটের নামে চাল বাজারজাত করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন করা হচ্ছে।
তীর মিনিকেট সর্বোচ্চ ৭৫ টাকা কেজি
গত সেপ্টেম্বরে বেশি দাম রাখায় মামলা হয়েছে। তখন মিনিকেট চাল ৭০ টাকা কেজি বিক্রি করা হত। কিন্তু মামলার নিস্পত্তি না হলেও রাজধানীর কৃষিমার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ অলিগলিতে বেশি দামে সিটি গ্রুপের তীর ব্রান্ডের চাল বিক্রি করতে দেখা গেছে। সরেজমিনে গেলে কৃষিমার্কেটের সাপলা রাইস এজেন্সির শিপন, চৌধুরী রাইস এজেন্সির গোলাম রসুলসহ অন্যন্য চাল ব্যবসায়ীরা ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, কর্পোরেটের দখলে চলে গেছে চালের বাজার। তাইতো রশিদ, মোজ্জামেলের চেয়ে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেশি দামে তীরের মিনিকেট সর্বোচ্চ বেশি দামে বিক্রি করছে। তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। মোহাম্মদপুরের ফিউচার টাউন হাউজিং আল আমিন এন্টারপ্রাইজের আনোয়ার বলেন, আগে অন্য মিনিকেট চাল বিক্রি করা হলেও তীরের মিনিকেট চাল সবচেয়ে বেশি ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের দেখা উচিত।
মামলার শুনানির পর তদন্ত শুরু
ধানের ভরা মৌসুমেও চালের দাম কমছে না। আটা, সয়াবিন তেল, ডিম,মুরগিও বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, ডলারের অজুহাতে ইউনিলিভারসহ বিভিন্ন কোম্পানি সাবান, পাউডার বেশি দামে বিক্রি করছে।
এ নিয়ে দেশে হই-চই পড়লে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত প্রশ্ন করেন এতো দাম বাড়ছে কেন? তারপর থেকেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। বাধ্য হয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর সারাদেশে বাজারে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় তারা দেখতে পায় বিভিন্ন নামীদামি প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বেশি দামে বিক্রি করছে। এর কারণ জানতে চাল, তেল, আটাসহ বিভিন্ন খাতের উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজনও করে ভোক্তা অধিদপ্তর। সেখানে দাম বেশি নেওয়ার কারণ স্পষ্টভাবে জানতে চাওয়া হয়। অনেকে সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। বাধ্য হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ আমলে নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সিটিগ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা করে।
প্রতিযোগিতা কমিশন বলছে, সরকারের লাইসেন্স নিয়ে যে কেউ বৈধপথে ব্যবসা করতে পারবে। নিয়ম মেনেই তা করতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে, বোরো ধানের ভরা মৌসুমেও কমেনি চালের দাম। বরং সিটি গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইচ্ছামতো মিনিকেট নামে বেশি দামে চাল, সয়াবিন তেল ও আটা বিক্রি করছে। বাধ্য হয়ে সিটি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে বেশি দামে চাল বিক্রি করার অপরাধে গত ২৬ সেপ্টেম্বর (২৪/২০২২) ও আট-ময়দা বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে (৩৮/২০২২ নং) মামলা করে।
শুনানীতে কমিশন থেকে বলা হয়, মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। বিআর-২৮, জিরাসাইল, নাজিরসাইল থেকেই পলিশ (চিকন) করে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে ভোক্তারা শুধু বিভ্রান্তি নয়, প্রতারিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলার শুনানির আদালত তাদের কাছে জানতে হয়েছে কেন বেশি দামে চাল, সয়াবিন তেল আটা বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রথম শুনানিতে বেশি দামে পণ্য বিক্রির জবাব দিতে না পারায় দ্বিতীয় বার শুনানি হয়েছে। এ সব ব্যাপারে তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে, তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আইনের আওতায় দোষী সাব্যস্ত হলে জরিমানা করা হবে। ১৫ ও ১৬ ধারায় অর্থাৎ ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য অস্বাভাবিকভাবে নির্ধারণ ও কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহারে অভিযোগে এ সব মামলা হয়েছে।
মামলার পরও বেশি দামে আটা বিক্রি, চিনি ছাড়া বাজার
সিটিসহ বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করার সময় ২ কেজি আটা ১৩৫ টাকা বিক্রি করা হতো। সরকার চিনির দাম ৯৫ থেকে ১০৭ টাকা কেজি ঘোষণা করেছে গত ১৭ নভেম্বর। তারপরও সহজে মিলছে না আটা ও চিনি। এ ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের লক্ষীপুর স্টোর, ইউসুফ জেনারেল স্টোর, আব্দুর রব স্টোরসহ অনেক খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, চিনি ৯৫ থেকে ১০৭ টাকা কেজি করেছে মিল থেকে। তারপরও চাহিদা মতো পাওয়া যাচ্ছে না। এই মার্কেটের তৃতীয় তলায় সিটি গ্রুপের ডিলারের লোক শুধু দিব দিচ্ছি বলেও চিনি দিচ্ছে না। তাই আমরা বিক্রি করতে পারছি না।
খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার দাম বেধে দেওয়ার পর থেকেই তারা চিনি পাচ্ছেন না। মাঝে মধ্যে পাওয়া গেলেও দাম বেশি চায়। তাই জরিমানা খাওয়ার ভয়ে কিনি না। তাদের অভিযোগ মিল থেকে কি কোনো চিনি উৎপাদন হয় না। তাহলে সেগুলো যাচ্ছে কোথায়?
এদিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষিমার্কেটেও একই দশা। বিক্রমপুর এন্টারপ্রাইজ, সিটি এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, চিনি নেই। বেশি দাম না দিলে পাওয়া যায় না। আবার বেশি দামে কিনে জরিমানা খেতে হচ্ছে। তাই চিনি রাখি না। নেই কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, কিছু জানতে হলে সিটিগ্রুপের ডিলার খালেক এন্টারপ্রাইজে যান। তাদের কথা মোতাবেক খালেক এন্টারপ্রাইজে গেলে দেখা যায়, সারি সারি তীর মিনিকেট চালে বস্তা। চিনির ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির মালিক খালেক জানান, চিনি নেই। চাইলেও পাওয়া যায় না। মিল থেকে শুধু দিব দিব বলে দিচ্ছে না। তাই আমরাও বিক্রি করতে পারছি না।
একই মার্কেটের সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহের বলেন, ‘চিনি না থাকায় ব্যবসার লোকসান হচ্ছে । কোম্পানির সিন্টিকেটের কারণে ভোক্তারা চিনি পাচ্ছেন না। দুই তিন মাস আগে সিটি গ্রুপের ২ কেজি আটা ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা ছিল। কিন্তু সিটির গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর সেই আটা ১৫০ করেছে। বর্তমানে কমিয়ে সেই আটা ১৩৫ টাকা ঘোষণা দিলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না।
সিটি গ্রুপের বক্তব্য
এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে রবিবার (৮ জানুয়ারি) সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘মামলা হয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে এখনো কিছু হয়নি। প্রতিযোগিতা কমিশন শুধু কাগজপত্র চেয়েছে।
অন্য কোম্পানির চেয়ে বেশি দামে মিনিকেট চাল বিক্রি করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কস্টিং (খরচ) বেশির কারণে দাম বেশি হবে, এটাই স্বভাবিক।
এনএইচবি/আরএ/