রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ভয়ংকর’ কিশোর গ্যাং
রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা থামছেই না। বরং কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। এরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় অপরাধ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠা কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। তারা নানা অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তাতে রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় সচেতন মহলসহ সবাই তৎপর না হলে এই গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এদের অপরাধের বিস্তার এতোটায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে, আগামীতে কিশোর গ্যাংই হবে নগরবাসীর দুশ্চিন্তার বড় কারণ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুত্র বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গড়ে উঠছে এ সব কিশোর গ্যাং। তারা বিভিন্ন অপরাধ সংগঠনের পাশাপাশি নিজেদের একটা জগত তৈরি করেছে ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, পাড়া-মহল্লায় তৈরি হওয়া কিশোর গ্যাং নিজেদের তৈরি করা সাংকেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে। বিগবস, নাইন এমএম, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ ইত্যাদি নামে পরিচিত ‘কিশোর গ্যাং’ আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের ভয়ংকর মহড়া, মাদক এবং ইয়াবা সেবন ও বিক্রি, চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এমনকি বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ছে।
পুলিশের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে মিরপুর এলাকায়। এ ছাড়া তেজগাঁও, উত্তরা, গুলশান, ওয়ারী, সায়দাবাদ, মতিঝিলে, রমনায়, লালবাগ, গাবতলী, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, আজিমপুর, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় তারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
এদের পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষক বা রাজনৈতিক গডফাদারদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো রাজনৈতিক ভাবে দেখা হচ্ছে। পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক শেলটারদাতা বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অর্ধশত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। কেউ কেউ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সুবিধার জন্য সরকারি দলের সাইনবোর্ড এবং পদ-পদবিও নিয়েছেন।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, গত কয়েক বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের কারণে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। একটি ঘটনার পর পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে কিছু দিন ভাটা পড়ে, পরে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে কিশোর গ্যাং।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীরা কিশোরদের ব্যবহার করে অপরাধ করায়। তারা মারামারি, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে দল বড় করা, হিরোইজম দেখানো, ভয়ভীতি এবং এদের কেউ কেউ আবার মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেও এই কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম দিয়েছে। তা ছাড়া টিকটক ও নাটক-সিনেমার আড়ালে অপরাধ করার জন্যও এই গ্যাং তৈরি হয়।
গোয়েন্দা তথ্য মতে, দিনে দিনে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ বেড়েই চলেছে। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাসহ সারাদেশে বিস্তার ঘটেছে কিশোর অপরাধের। তাদের দাবি, আজ থেকে কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের চিত্র এমন ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ থেকে সরে এসে কিশোররা নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।
কিশোর গ্যাং এর বিভিন্ন অপরাধ বিশ্লেষণের পর গোয়েন্দারা বলছেন, অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের সন্তানের খোঁজ নেয় না। তারা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তার খোঁজও নিচ্ছেন না। যার কারণে এমন অপরাধ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
পুলিশি তথ্য মতে, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আবার কিশোর অপরাধ আইন ও ধারা অনুযায়ী বড় অন্যায় করেও পার পেয়ে যাচ্ছে অনেকেই। ছাড়া পেয়ে আবার যুক্ত হচ্ছে নতুন অপরাধে। আর ওই কিশোরের অপরাধের দায় ভোগ করতে হচ্ছে পরিবারকে।
অনেক সময় সংবাদমাধ্যমে যাদের কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয় পরবর্তীতে দেখা যায়, তারা কেউ মাদক চোরাচালান, কেউ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও বহনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। মূলত অল্প বয়সে তারা ধ্বংস হচ্ছে। পুলিশের দাবি, অবিলম্বে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ও অভিভাবকদের এই বিষয়ে সতচেতন হতে হবে। অন্যথায় এর দায়ভার সমাজের সবাইকে বহন করতে হবে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর গ্যাং ভয়াবহভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই গ্যাং বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাতি নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় কাউন্সিলরসহ অনেক নেতা-কর্মীরা জড়িত। কিশোররা না বুঝে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর অপরাধ দমন করতে হলে আইনি, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, 'কিশোর অপরাধ অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তবে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি আলোচনায় আসে ২০১৭ সালের শুরুতে। স্কুল ছাত্র আদনান কবীর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। কিশোর গ্যাং বিস্তারের অন্যতম কারণ হলো সামাজিকভাবে তাদের প্রতিহত করার জায়গাটি অনেক দুর্বল। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এজন্য এর প্রভাব বেড়েই চলেছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মসজিদ কমিটি থেকে স্কুল কমিটি, রাজনীতি, পরিবার সব জায়গায় দ্বন্দ্ব, মারামারি, কলহ। আমাদের শিশু-কিশোররা এ সব সংস্কৃতির মধ্যে বড় হচ্ছে। তাই তারাও নানাভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর অপরাধ কমাতে যারা দ্বায়িত্বপূর্ণ জায়গায় আছে তাদের আগে ঠিক করতে হবে।
মহানগর পুলিশ জানায়, কিশোর অপরাধ দমনে সচেতন নাগরিকদের এ সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। সঠিক তথ্য পেলে হয়ত কিশোর অপরাধ কমে আসবে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, কিশোর অপরাধ ঠেকাতে কঠোর হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী। ইতোমধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সব থানায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি এ বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও কাজ করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া বিশেষ করে উঠতি বয়সি ছেলেরা নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাদের পুলিশের পক্ষ থেকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। এই ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে শুধু মেট্রাপলিটন পুলিশ নয় সারা দেশের পুলিশ কাজ করছে। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাং হলো আমাদের সামজের একটি মারাত্মক ব্যাধি। ছোটখাটো ছিনতাই থেকে শুরু করে মাদক সেবন, মেয়েদের ইভটিজিং করা এমনকি নিজেদের মহল্লায় জুনিয়র-সিনিয়র সংঘাতের কারণে খুনের ঘটনাও ঘটছে। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আমরা কাজ করছি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, 'কিশোর অপরাধ বাড়ার পেছনে সব স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা আছে। মূলত সমাজের বিভিন্ন ছোটো ছোটো অপরাধ করতে করতেই কিশোররা বড় ধরনের অপরাধ করে থাকে। নৈতিক শিক্ষার অভাবে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। তা ছাড়া পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কিছু ঘাটতি আছে।
তিনি বলেন, সমাজে যারা আধিপত্য বিস্তার করতে চায় তারা কিশোরদের নানাভাবে মদদ দেয় এবং তাদের দিয়ে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অন্যায় কাজ করায়।
এনএইচবি/আরএ/