৩৯টিতে বাদ রেখেই কেন্দ্রীয় সম্মেলন
বাড়ছে পদপ্রত্যাশীদের প্রতিযোগিতা
বছর জুড়ে উপজেলা-জেলা সম্মেলন হলেও নেতৃত্বে আসছে না খুব একটা একটা পরিবর্তন। সারা দেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলা ৭৮টি। এরমধ্যে ৩৯টির সম্মেলন হয়েছে।
সম্মেলন হওয়া ৩৯টির মধ্যে প্রায় সবকটিতেই সভাপতি-সম্পাদক নির্ভর কমিটি হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে মাত্র ৭টি জেলা। অন্যদিকে, নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি ২৪টিতে এবং নেতৃত্বের আংশিক পরিবর্তন হয়েছে ৮টিতে। উপজেলা পর্যায়েও একই চিত্র। ১৫ থেকে ১৮/২০ বছর সম্মেলন হয়নি, এমন উপজেলায় সম্মেলন হয়েছে। সম্মেলনের পর নেতৃত্ব নিয়ে বেশ কয়েকটি উপজেলায় হাতাহাতি ও চেয়ার ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে।
কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি ক্ষোভ দেখিয়েছে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তারপরও গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায় ২৪ ডিসেম্বর ২২তম জাতীয় সম্মেলন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
তৃণমূল নেতারা বলছেন, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র সবখানেই বাড়ছে পদপ্রত্যাশী নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। পদ না পেয়ে অনেক সাবেক ছাত্রনেতারা এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকছেন। কারণ, টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনায় থেকে ৪টি সম্মেলনে নতুন নেতা তৈরি হয়েছে মাত্র ৭৭ জন। সভাপতি পদে পরিবর্তন নাই; সাধারণ সম্পাদক পদে মাত্র দু’বার পরিবর্তন হয়েছে। অথচ দলে যেমন নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন আছে, তেমনি অভিজ্ঞদেরও প্রয়োজন। সামনে নির্বাচন, এ সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলন রাজপথে মোকাবিলায় দলে অভিজ্ঞ নেতারা পদে আসলে অনেকটাই সহায়ক হবে বলেও জানান সংশ্লিষ্ট নেতারা।
এদিকে ২২তম জাতীয় সম্মেলনের কাউন্সিলর ও ডেলিগেট কার্ড বিতরণ শুরু করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে জেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও তাদের প্রতিনিধিদের কাছে এই কার্ড দেওয়া হচ্ছে। সম্মেলনের কাউন্সিলর ও ডেলিগেট কার্ড সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন বিভাগের জন্য রয়েছে পৃথক বুথ। বুধবার (২১ ডিসেম্বর) এই কার্ড বিতরণ শুরু হয়। আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে সারাদেশ থেকে ৭ হাজার কাউন্সিলর এবং এক লাখের অধিক ডেলিগেট অংশ নেবেন।
মঞ্চ সাজসজ্জা উপ-কমিটির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম জানিয়েছেন, কাউন্সিলে প্রবেশের জন্য ৫টি গেট থাকবে। তার মধ্যে একটি ভিআইপি ও চারটি গেট থাকবে ডেলিগেট ও কাউন্সিলদের প্রবেশের জন্য। আমাদের কাউন্সিলরের সংখ্যা ৭ হাজার। এ ছাড়া, এক লাখের অধিক ডেলিগেট অংশ নেবেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক চিত্র
২০০৯ সালের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল ৭৫ সদস্যের, নতুন নেতা হয়েছেন ২০ জন। ২০১২ সালের সম্মেলনে ৭৫ সদস্যের কমিটিতে নতুন নেতা হয়েছেন ১২ জন। ২০১৬ সালের সম্মেলনে ৮১ সদস্যের কমিটিতে নতুন মুখ এসেছে ২৮। ২০১৯ সালের সম্মেলনেও ৮১ সদস্যের কমিটিতে নতুন মুখ ছিল ১৭ জন। আসন্ন ২২তম জাতীয় সম্মেলনেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সিংহভাগ পদেই পরিবর্তনের সম্ভাবণা ক্ষীণ থাকছে। তবে মৃত্যুজনিত কারণে শূন্য হওয়া পদ পূরণ করা বা দায়িত্ব পুনর্বণ্টন ছাড়া, নেতৃত্বে তেমন পরিবর্তন আসবে না বলেই শোনা যাচ্ছে।
ঢাকা বিভাগ
ঢাকা বিভাগে রয়েছে ১৭টি সাংগঠনিক জেলা শাখা। এরমধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ মহানগর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও কিশোরগঞ্জ, এই ৭টির সম্মেলন হয়নি। ১০টির সম্মেলন হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলা শাখা। বাকি ৭টিতেই পুরোনো নেতৃত্ব।
আট বছর পর সম্মেলন হয়েছে ঢাকা জেলার। ২০০৪ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসা বেনজিরই রয়ে গেছেন সভাপতি। তবে সম্পাদক পদে আসছে পরিবর্তন। গাজীপুর জেলা এবং মহানগরেও হয়নি নেতৃত্বের পরিবর্তন। দীর্ঘ ৭ বছর পর সম্মেলন হলেও নরসিংদীতে ভারপ্রাপ্তদের ভারমুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সাত বছর পর সম্মেলন হয়েছে রাজবাড়ি ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের। এগুলোতে নেতৃত্বের নেই পরিবর্তন। একই অবস্থা মানিকগঞ্জের।
চট্টগ্রাম বিভাগ
দলের সাংগঠনিক জেলা ১৫টি। সম্মেলন হয়েছে ৮টিতে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি ৫টির। বাকি দুটির সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেও স্থগিত করা হয়েছে। সম্মেলন হওয়া ৮টির সবগুলোতেই বহাল আছে পুরোনো নেতৃত্ব।
রাজশাহী বিভাগ
আওয়ামী লীগের ৯টি সাংগঠনিক জেলা শাখা। এর মধ্যে বগুড়া, রাজশাহী জেলা ও মহানগর শাখার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি। বাকি ৬টির সম্মেলন হয়েছে। এখানে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাকিগুলোতে বহাল রয়েছে পুরোনো নেতৃত্ব। সম্মেলন হয়নি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের।
খুলনা বিভাগ
সাংগঠনিক জেলা ১১টি। সম্মেলন হয়েছে ৪টিতে। সবগুলোতেই বহাল রয়েছে পুরোনো নেতৃত্ব। বাকি ৭টির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি। এগুলো হলো- কুষ্টিয়া, নড়াইল, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষিরা, খুলনা জেলা ও মহানগর শাখা।
বরিশাল বিভাগ
এই বিভাগে সাংগঠনিক জেলা ইউনিট ৬টি। ঝালকাঠি ও পটুয়াখালী শাখার কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়নি। বাকি চারটির তিনটিতে সম্মেলন হলেও নেতৃত্ব অপরিবর্তিত। হয়নি বরিশাল জেলা সম্মেলন। যদিও জাতীয় সম্মেলনের আগে সম্মেলন হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে ৩০ বছরে সাত বার। প্রতিবারই একই নেতৃত্ব রয়ে গেছে। ৭ বছর পর কমিটি করলেও পিরোজপুরে বহাল পুরোনো নেতৃত্ব। শুধু ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আংশিক পরিবর্তন হয়েছে।
রংপুর বিভাগ
এই বিভাগে সাংগঠনিক জেলা ১০টি। ১০টির মাঝে মাত্র তিনটিতে সম্মেলন হয়েছে। এরমধ্যে গাইবান্ধা পেয়েছে নতুন নেতৃত্ব। দিনাজপুরে নেতৃত্বে আছেন পুরোনো সভাপতি। পঞ্চগড়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ ছাড়া, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি-কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রংপুর জেলা ও মহানগর শাখার।
সিলেট বিভাগ
পাঁচটি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এই মেয়াদে একটিরও সম্মেলন করা হয়নি। গত সম্মেলনের আগ মুহূর্তে সম্মেলন হয়েছিল হবিগঞ্জ, সিলেট জেলা ও মহানগর শাখার। সে কারণে এগুলোকে মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হয়নি। আর মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও সম্মেলন হয়নি মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলা শাখার।
ময়মনসিংহ বিভাগ
ময়সনসিংহ বিভাগের জেলা ইউনিট ৫টি। সবগুলোরই সম্মেলন হলেও নতুন নেতৃত্ব এসেছে মাত্র একটিতে। ছয় বছর পর ময়মসিংহ জেলা ও মহানগরে হয়েছে সম্মেলন। ইউনিট দুটিতে সভাপতি পদে পরিবর্তন হলেও অপরিবর্তিত রয়েছেন সাধারণ সম্পাদক। শেরপুরে প্রায় ৮ বছর পর সম্মেলন হলেও সভাপতি পদে হ্যাট্রিক করেছেন হুইপ আতিক। তবে পরিবর্তন হয়েছে সাধারণ সম্পাদক পদে। একই অবস্থা জামালপুরেও। দীর্ঘ ৭ বছর পর নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে, এসেছে নতুন নেতৃত্ব।
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে গঠিত উপ কমিটিতে যারা
২২ তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত খসড়া কমিটি গুলো হলো-সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক শেখ হাসিনা; সদস্য সচিব ওবায়দুল কাদের, অভ্যর্থনা উপকমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সদস্য সচিব দীপু মনি, অর্থ উপকমিটির আহ্বায়ক কাজী জাফরউল্লাহ; সদস্য সচিব এইচএন আশিকুর রহমান, ঘোষণাপত্র উপকমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম; সদস্য সচিব আব্দুর রহমান, দপ্তর উপকমিটির আহ্বায়ক ড. অনুপম সেন; সদস্য সচিব ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, মঞ্চ ও সাজসজ্জা কমিটির আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবির নানক; মির্জা আজম, প্রচার ও প্রকাশনা কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপপু; সদস্য সচিব ড. আবদুরস সোবহান গোলাপ, স্বেচ্ছাসেবক ও শৃঙ্খলা উপকমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ; সদস্য সচিব আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, গঠনতন্ত্র সংশোধন উপকমিটির আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক; সদস্য সচিব সেলিম মাহমুদ, স্বাস্থ্য উপকমিটির আহ্বায়ক মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন; সদস্য সচিব রোকেয়া সুলতানা, সাংস্কৃতিক উপকমিটির আহ্বায়ক আতাউর রহমান; সদস্য সচিব অসীম কুমার উকিল, খাদ্য উপকমিটির আহ্বায়ক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও সদস্য সচিব অ্যাড. কামরুল ইসলাম।
২২ ডিসেম্বর শেষ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক
আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির শেষ বৈঠক ডাকা হয়েছে আগামী ২২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায়। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগে হতে যাচ্ছে শেষ কার্যনির্বাহী কমিটির সভা। সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনীর খসড়া। অবহিত করা হবে কাউন্সিলের আয়োজনের সার্বিক প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা। অনুমোদন দেওয়া হবে সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের প্রতিবেদন। দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিজ নিজ দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের সাংগঠনিক প্রতিবেদন তুলে ধরবেন সভায়। এ ছাড়া, সভায় সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত ১১টি সম্মেলন প্রস্তুতি উপ-কমিটির নেতারা তাদের প্রতিবেদন পেশ করবেন।
এমএইচ/এমএমএ/