জ্বালানিতে ভর্তুকি কমাতে সরকারের যত উদ্যোগ, নানা আশঙ্কা
তেলসহ সব ধরনের জ্বালানির উপর থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। তিন মাস পর পর দাম সমন্বয়, আমদানি ও বিপণনে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা এবং নিজস্ব গ্যাসের সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়ানোর মতো পদক্ষেপের কথা চিন্তা করছে সরকার।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো দাম বাড়াতে চাইবে অধিক মুনাফার জন্য। সরকারি নিয়ন্ত্রণ সেই মাত্রায় নাম থাকলে সাধারণ মানুষ অসুবিধায় পড়বে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত এক বৈঠকেও অন্যান্য এজেন্ডার পাশাপাশি জ্বালানিতে ভর্তুকির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অভিমত দেওয়া হয় যে, জ্বালানিতে বিশাল ভর্তুকি পরিমাপ করতে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্ব বাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয় করা উচিত।
বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জ্বালানি তেলের দাম এখন থেকে প্রতি তিন মাস পর পর বাড়বে বা কমবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে জ্বালানি তেলে ভর্তুকির বোঝা কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
বর্তমানে জ্বালানি তেল আমদানি করে রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। কিন্তু সম্প্রতি সরকার পরিকল্পনা করছে আমদানিতে বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভূক্ত করার। এটি বাস্তবে রূপ নিলে জ্বালানি তেল আমদানি করে ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে পারবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও।
বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধি আর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে বহুদিন ধরেই জ্বালানি তেলের আমদানি ও বিক্রিতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। আইএমএফের ঋণ পেতে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম জ্বালানি তেলের উপর ভর্তুকি কমিয়ে আনা। জ্বালানির মূল্য-নির্ধারণ পদ্ধতি বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম খোলাবাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ দাম সমন্বয় হবে। যেমনটা আমরা এখন এলপিজির দাম প্রতি মাসে সমন্বয় করি।
বেসরকারি খাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা নিয়ে সংশয়
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন বিপিসি আমদানি করছে। তারা ভর্তুকি দিচ্ছে। লাভ করছে না বেশিরভাগ সময়েই। কিন্তু বেসরকারি খাতে দিয়ে দিলে তারা তো আর মানুষের সুবিধা-অসুবিধা দেখবে না। তারা চাইবে মুনাফা করতে।
এখন সরকার এ সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর কতটুকু নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবে সেটা দেখার বিষয়।এই নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে গেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নানাভাবে দাম বাড়াতে চাইবে। ফলে সাধারণ মানুষ অসুবিধায় পড়বে।
বর্তমানে লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপি গ্যাসের দাম সরকারিভাবে বেঁধে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের দর, আমদানি ও পরিবহন খরচ, মুনাফা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে প্রতিমাসে একবার এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রিতে বেসরকারি খাত যুক্ত করা হলেও দাম নির্ধারণে এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলছেন, প্রাইভেট সেক্টরে গেলেও দামটা যেন তাদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করা না হয়, সেখানে যেন নিয়মনীতি ও নজরদারি থাকে।
গ্যাসের সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে এবং অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় বাংলাদেশ তার মজুদ খুঁজে বের করতে এবং ট্যাপ করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের তুলনায়ও বাংলাদেশ অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে কম। ত্রিপুরার মতো ছোট্ট একটি রাজ্য যেখানে ১৫০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে সেখানে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকারী দেশের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মাত্র এক তৃতীয়াংশ গ্যাস অনুসন্ধান করা হয়েছে। গ্যাস আবিষ্কারের সাফল্য যদিও এখানে বৈশ্বিক গড় থেকে অনেক বেশি, তারপরও এখানে অনুসন্ধান কমই হয়েছে।
এ ছাড়া, গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা রয়েছে যেটা ২৬টি ব্লকে বিভক্ত। এর মধ্যে ২৩টিই এখনো উন্মুক্ত। মাত্র তিনটি ব্লকে ভারত ও সিঙ্গাপুরের তেল কোম্পানি অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
অথচ ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ মিটে যাওয়ার পর দুটি দেশই তাদের সমুদ্রসীমা দ্রুত অনুসন্ধান চালিয়ে গ্যাস আবিষ্কারও করেছে। মিয়ানমার তার আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন ইতোমধ্যে শুরু করেছে। ভারত ২০২৩ সাল থেকে উত্তোলন শুরু করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সংকটকে রাশিয়াা-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে দাবি করা হলেও তা আংশিক সত্য। মাটির নিচ থেকে গ্যাস উত্তোলনে কাজ না করা এই সংকটের অন্যতম কারণ।
পরিস্থিতি জটিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে সরকার নিজস্ব অনুসন্ধানে মনোযোগ বাড়িয়েছে। সম্প্রতি ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ বলছে, এখান থেকে জাতীয় গ্রিডে ভালো পরিমাণে গ্যাস যুক্ত করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক বিবৃতিতে জানান, নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান, উৎপাদন বৃদ্ধি ও কূপগুলোর আরও গভীরে খনন করার জন্য গ্যাসের অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছে সরকার। আগামী তিন বছরের জন্য একটা আপগ্রেডেশন, ওয়ার্কওভারের স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৪৬টি কূপ থেকে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আরইউ/আরএ/