১৮ রুটে মানবপাচার
দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত অনেকেই
অন্তত ১৮ রুট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানবপাচার হচ্ছে। পাচারের শিকার এসব বাংলাদেশিদের অনেকেই নানামুখী অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরছেন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে। ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ না পেলেও অনেককেই মাসের পর মাস বন্দি থাকতে হচ্ছে অপরাধীদের হাতে। সম্প্রতি পাচার হওয়া বেশ কয়েকজন দেশে ফিরে এলে তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দারা বলছেন, মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত দালাল চক্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা জড়িত রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা মানুষদের সর্বশান্ত করছে পাচার চক্র। মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। লোভনীয় চাকরি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ জীবনও হারিয়েছেন।
গোয়েন্দারা বলছেন, পুলিশ, র্যাব, সিআইডি ও ডিবি মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত যাদের ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, কয়েকটি ধাপে মানবপাচারের কাজ করেন তারা। এ সব অপরাধীরা প্রথমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের বাছাই করে। এরপর তাদের পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট কেনার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা নেয়। পরে প্রাথমিক কাজ শেষ করে মানবপাচার চক্রটি রুট চিহ্নিত করে।
অপরাধীরা মানবপাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের ইস্তানবুল হয়ে লিবিয়া একটি রুট, বাংলাদেশ থেকে ভারত-শ্রীলঙ্কা হয়ে লিবিয়া এবং দুবাই-জর্ডান হয়ে লিবিয়া-এই ৩টি রুট ব্যবহার করে বেশি। যে রুটই ব্যবহার করা হোক না কেন, লিবিয়ার ত্রিপলিতে নেওয়ার পর সেখান থেকে ইউরোপের দিকে পাঠানো হয়।
সম্প্রতি জাল ভিসা তৈরি করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানব পাচারকারী এবং জাল ভিসা তৈরি চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর সিআইডি বলছে, গ্রেপ্তারকৃত আসামি মোহাম্মদ ফয়েজুল্লাহ কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভুয়া এবং জাল পাসর্পোট তৈরি করে সাধারণ মানুষদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। সে অনেক মানুষের জীবন নষ্ট করেছে।
বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও দেশি- বিদেশি মুদ্রা পাচারকারী চক্রের মূল হোতা সাইফুর আকন ওরফে নাসিরকে গ্রেপ্তারের পর সিআইডি জানায়, এই প্রতারক ভিকটিমকে বিদেশে আটকে রেখে আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এভাবে মুক্তিপণ হিসেবে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে মোট ২৬ লাখ ৫১ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাইফুর।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা আমাদের দেশের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভুয়া এবং জাল পাসর্পোট তৈরি করে সাধারণ মানুষদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। চলতি মাসে দালালচক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত চক্রের বেশ কিছু সদস্যের সন্ধান পেয়েছি। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবপাচারের সঙ্গে রাজধানীসহ ১৫ জেলার অন্তত ৮টি গ্রুপ জড়িত। মানবপাচার চক্রের এইচ আটটি গ্রুপের সন্ধানে মাঠে নেমেছে র্যাব, সিআইডি ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। লিবিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ থাকায় পাচারকারী সিন্ডিকেট ভ্রমণ ভিসায় বিদেশগামীদের ভারত, নেপাল, দুবাই, মিসর ও জর্ডান ঘুরিয়ে বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের পাচার করছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মানবপাচারের মামলায় দেশের দালাল ও সহযোগীদের গ্রেপ্তার করলেও লিবিয়া, দুবাই ও ইতালিতে থাকা মূলহোতাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। আন্ত:দেশীয় তদন্ত না হওয়ায় লিবিয়ার ফার্ম হাউসে সক্রিয় পাচারকারী পর্যন্ত পৌঁছায়নি তদন্ত কার্যক্রম। অবশ্য সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আমাদের একটি গোয়েন্দা তথ্যে বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। তারা দেশের বাইরে রয়েছে।
সম্প্রতি দুবাইয়ে ১৯ মাস মানবেতর জীবনযাপন করে দেশে ফিরে আসেন মিজানুর রহমান ওরফে শাওন আহমেদ নামের এক ভুক্তভোগী। তার ভাই দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের মতো মানুষ স্বপ্নের দেশে পৌঁছাতে গিয়ে পড়ছেন বিভিন্ন সংকটে। মিথ্যা আশ্বাসে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হতে হচ্ছে আমাদের। তিনি বলেন, বিদেশে গিয়ে উন্নত জীবনযাপন করবে এমন আশায় জমানো কিছু টাকার পাশাপাশি ঋণ করেও টাকা যোগাড় করি। কিন্তু এর বদলে কোনো ভাবে জীবন নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে তার ভাই দেশে ফিরে এসেছে।
শাওনের পরিবার জানায়, ২০১৯ সালে মো. আবু বক্কর সিদ্দিক নামে একজন দালালের মাধ্যমে ইউরোপে যেতে ১৫ লাখ টাকা প্রদান করেন তারা। এরপর দালাল আবু বক্কর ভিকটিম শাওনকে প্রথমে দুবাই পাঠান। সেখানে ২ মাস থাকতে হবে বলে জানায় চক্রটি। সেখান থেকে ভিসা নিয়ে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলা হলেও এরপর আর ইউরোপে পাঠানো হয়নি। বরং তাকে আটকে রেখে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। পরে তারা বুঝতে পারে যে শাওন দালালের খপ্পরে পড়েছে। এরপর ভুক্তভুগী মিজানুর রহমান দুবাইতে ১৯ মাস মানবেতর জীবনযাপন করে নিজ খরচে আবার দেশে ফিরে আসে।
এই ঘটনায় আবু বক্করের বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুল থানায় চলতি বছরের ১২ নভেম্বর একটি ডায়েরি করেছে শাওনের চাচাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন। পরে এই অভিযোগটি ১৩ নভেম্বর র্যাব-১ এর হাতে আসে এবং দালাল চক্রের মূল হোতা আবু বক্করকে গ্রেপ্তার হয়।
জানতে চাইলে কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের থানায় প্রায় মানবপাচার নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। সেগুলো নিয়ে আমাদের থানা পুলিশ কাজ করছে। তবে যেসব ঘটনায় সাধারণ ডাইরি হয় সেসব বিষয়ে জোরালো তদন্ত করে আমাদের তদন্তকারী কর্মকর্তারা এবং আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগে দেশে ২৯টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর ২৫টি তদন্ত করে ২৩টির অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। একটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। অন্যটি তদন্তাধীন। তদন্তে পাচারচক্রের ২৯৯ জনের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে ১৭১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি, পুলিশ ও র্যাব। এদের ৪২ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। বাকি ১২৮ জন অধরা।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মানবপাচার রোধে আমরা নিয়মিত বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছি। এসব ঘটনায় ভিকটিমদের অভিযোগগুলো আমলে নিয়েই আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে থাকি। তা ছাড়া সম্প্রতি আমরা মানবপাচার চক্রের অনেক সদস্যকে আইনের আওতায় এনেছি। ইতোমধ্যে মানব পাচারকারী চক্রের মূল
হোতাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, মানবপাচারকারী চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে সকলকে সচেতন হতে হবে। দালাল চক্রের সদস্যরা আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। চক্রের মূল হোতারা দেশের বাইরে বসে অনলাইন ভিসা ও বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে। যার কারণে অনেক সময় তাদের ধরা বা আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়ে উঠে না।
এনএইচবি/আরএ/