নেপথ্যে হুন্ডি
১১ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেলেও কাটছে না ডলার সংকট
চলতি বছর সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে গেছেন প্রায় ১১ লাখ বাংলাদেশি। তারপরও দেশে রেমিট্যান্স এসেছে অনেক কম। এর মূল কারণ হুন্ডি বেড়ে যাওয়া। বিদেশে কর্মরতরা বৈধ চ্যানেলে অর্থাৎ ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
জানা গেছে, বিদেশ থেকে যারা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠান তাদের কোনোরকম ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয় না। কিন্তু যারা হুন্ডি কারবারি তারা বেশি লাভবান হন। তাদের ডলার বা পাউন্ড কিংবা ইউরো পাঠাতে হয় না। তারা নিজেদের লোকের মাধ্যমে টাকা দিয়ে দেন। আর ডলারসহ বিদেশি মুদ্রা থেকে যায় সংশ্লিষ্ট দেশে হুন্ডি কারবারির কাছেই।
এদিকে রেমিট্যান্স কম আসার কারণে বাধ্য হয়েই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ডলার সংকটও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ৮৭ টাকার ডলার ১০৭ টাকা করার পরও সহজে ব্যাংকে মিলছে না ডলার। বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ রয়েছে। অনেক ব্যাংক এলসি খুলছে না। শুধু তাই নয়, আগের এলসির বিলও পরিশোধ করতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ পাচারের কারণেই ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থ পাচার রোধে সরকার কঠোর না হলে এই সংকট মোকাবিলা কঠিন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, প্রপাগান্ডার কারণেই হুন্ডির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক মাস থেকে রেমিট্যান্স কমে যায়। এ জন্য সরকারি আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দেওয়া হয়। চলতি বছরে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ায় আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে।
অপরদিকে, গত মাস নভেম্বর থেকে রেমিট্যান্সও বাড়তে শুরু করেছে। আশা করি, আসন্ন রমজানে প্রবাসীরা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাবেন। তখন ডলারের সংকট কেটে যাবে।
তবে অর্থনীতিবিদ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর এ ব্যাপারে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সামনে নির্বাচন। এ জন্য হুন্ডির মাধ্যমে ডলার আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। শুধু কাগুজের ঘোষণার মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছের মানুষ টাকা পাচ্ছে। সেই টাকা তারা খরচ করছে।
এক প্রশ্নের জবাাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারের বিভিন্ন দুর্বলতার কারণেই অর্থ পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচার হচ্ছে। ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। আবার অনেক সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তারাও বিদেশে বাড়ি করছে। তারাও অর্থ পাচার করছে। এ ছাড়া বাণিজ্যের নামে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। মানে ডলার চলে যাচ্ছে। এ জন্য ডলার সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
অর্থ পাচার রোধ করতে না পারলে এভাবেই সংকট চলতে থাকবে। সরকারি কঠোর সিদ্ধান্ত ছাড়া সংকট এড়ানো সম্ভব নয়।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি ও কর্মসংস্থা ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লোক গেছেন এক লাখের বেশি। ফেব্রুয়ারিতে এ সংখ্যা নেমে আসে লাখের নিচে, ৯৩ হাজার। আবার মার্চে এক লাখ ২০ হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। এপ্রিলে কমলেও লাখের মধ্যেই থাকে। এতো জনশক্তি রফতানির পরও ডলার সংকট শুরু হয়। মে মাসে বিদেশগামীর সংখ্যা কমে ৭৭ হাজারে নামে। কিন্তু জুনে আবার বেড়ে এক লাখ ১২ হাজারে পৌঁছে। এভাবে গত ১০ মাসে সৌদিআরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন প্রায় সাড়ে ৯ লাখ বাংলাদেশি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সৌদি আররে গেছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বা ৫৭ শতাংশ। এরপর ওমানে ১৫ শতাংশ ও সংযুক্ত আবর আমিরাতে ৯ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি গেছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ গত ১২ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে জানান, চলতি বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাজের উদ্দেশে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ কর্মী গেছেন। এর বেশির ভাগই গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
এতো লোক কাজের সন্ধানে বিদেশ যাওয়ার পরও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসছে কম। উল্টো বেড়েছে হুন্ডি ব্যবসা।
অথচ করোনার সময় দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসায় গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। অথচ ওই মাসে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে বিদেশ গেছেন মাত্র ১৯ হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশি।
কর্মসংস্থান ব্যুারো সূত্রে জানা গেছে, কাজের সন্ধানে গত অক্টোবরে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৭৩ হাজার ১৩৪ জন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে প্রবাসীরা ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে নভেম্বর মাসে কিছুটা বেড়ে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। রেমিট্যান্স কম আসায় রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। কারণ সরকারি আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা গেছে, রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় গত বছরের আগস্টের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে বর্তমানে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ডলারের সংকট শুরু হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সময়ে দাম বেঁধে দেয়। এরপর থেকে রেমিট্যান্স আসা কমতে থাকে। অর্থনীতিবিদরা মুদ্রা বিনিময় হারের কার্যকর ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে বললে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি বাফেদার উপর ছেড়ে দেয়। কারণ ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা দর দিলেও হুন্ডি কারবারিরা ১১০-১১২ টাকা পর্যন্ত দিচ্ছে প্রবাসীদের। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এরফলে ডলারের সংকট কাটছে না। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে না।
এনএইচবি/আরএ/