পলাতক জঙ্গিদের খোঁজ নেই, বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) ১৪ শীর্ষ নেতা এখনো পলাতক। এরমধ্যেই আবার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কিছু সূত্র বলছে, জঙ্গিদের সক্ষমতা আগেরে চেয়ে বেড়েছে। জামিনে বের হওয়ার পর পলাতক জঙ্গিদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরকম অন্তত ৩২ জন জঙ্গি জামিনে রয়েছেন যাদের খোঁজ রাখেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, আনসার আল ইসলামের মূল নেতা মেজর (বরখাস্ত) জিয়াকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এ কারণেই হয়ত আদালতের মতো জনবহুল প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের সাহস দেখিয়েছে জঙ্গিরা।
জঙ্গি নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সময় দেখা গেছে জঙ্গিরা জামিনে বের হওয়ার পর তারা হারিয়ে যায়। তাদেরও গোয়েন্দা মনিটরিং করতে হয়। ওই সব জঙ্গিদের মনিটিরিং এর মধ্যে না রাখার কারণে ছোট ছোট কিছু ঘটনার মোকাবিলা করতে হয় পুলিশকে। যেটা হলো আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। গোয়েন্দা বাহিনীর তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনেক কিছু করা হয়। তাদের আগাম সতর্কতা দিতে হয়, অন্যথায় হামলার আশঙ্কা থেকে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেখা গেছে জঙ্গিরা ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশাল ও ভালুকার মাঝামাঝি সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের প্রিজন ভ্যানে ঝটিকা আক্রমণ চালায়। এ সময় এক পুলিশকে হত্যা করে জেএমবির দণ্ডপ্রাপ্ত তিন নেতাকে ছিনিয়ে নেয়। তাদেরই একজন জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন এখনো পুলিশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। পুলিশ কেনো তাদের এখনো গ্রেপ্তার করেনি নাকি গ্রেপ্তার করতে পারেনি? জঙ্গিদের তদারকি না করে গোয়েন্দা সংস্থা ভুল করেছে তারা জামিনে বের হয়ে যাওয়ার পর তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গোয়েন্দা তথ্য মতে, আসামি ছিনতাই বা আসামি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক বার ঘটেছে। চলতি বছরের ১১ মাসে সারাদেশে এমন ২৯টি ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে পুলিশকে। মোট ৩২ জন আসামি পালিয়ে গেছে। মার্চ, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে এ সব ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। এরমধ্যে চারটি ঘটনা আলোচনায় এসেছে। সবচেয়ে কম ঘটেছে জুন ও আগস্ট মাসে।
গত ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত পাড়া থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জনই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য। তারা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। জঙ্গি সংগঠনটির পরিকল্পনায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিক লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, সমকামী ও অধিকারকর্মীকে হত্যা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে ওই দিন আদালতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার দরকার ছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেরকম কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার পর থেকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের মধ্য দিয়ে জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি আদালত থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি গোয়েন্দা সংস্থার দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রথম বড় ধরনের জঙ্গিবাদের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় হামলা। ওই সময় গ্রেপ্তার হলেও পরে ছাড়া পাওয়ার পর মিল্লাত বাহিনীর প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর মতিউর রহমানকে আর কখনো খুঁজে পায়নি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
বিশ বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনো রমনা বোমা হামলার সব আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রমনা বোমা হামলার প্রথম চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামি কোনো না কোনোভাবে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এই ঘটনায় চলতি বছরে বোমা হামলার আসামি মুফতি শফিকুর রহমানকে র্যাব গ্রেপ্তার করলেও অনেক প্রশ্নের জবাব মিলেনি। ১৯৯৬ সালে উখিয়া-টেকনাফে গ্রেপ্তার হওয়া ৪১ জন জঙ্গি জামিন পাওয়ার পর আর কখনই তাদের খোঁজ রাখেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর থেকে পলাতক আছে উত্তরবঙ্গের ১৪ জন জঙ্গি, যাদের কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। এর মধ্যে সালেহীনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও জঙ্গিরা তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। পরবর্তীতে প্রত্যেকটি জঙ্গিবাদের ঘটনায় এই ১৪ জঙ্গির সম্পৃক্ততার কথা কোনো না কোনোভাবে সামনে আসে।
ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেছেন, ঢাকার আদালতের সামনে থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তাদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত বিভিন্ন হামলার আশঙ্কা ও ঝুঁকি থেকেই যায়। তারা আমাদের নজরদারিতে রয়েছে।
জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা যদি আগে থেকে গোয়েন্দা তথ্য পেতাম তাহলে হয়ত এমন ঘটনার জন্ম হতো না। আশা করি জঙ্গিদের তৎপরতা দমন করতে আমরা সক্ষম হব।
পলাতক জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে না পারা, সম্প্রতি ঢাকার আদালত থেকে দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ারসহ সার্বিক জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ বলেন, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাটি হলো সার্বিক অবহেলা। কীভাবে এই ঘটনাটি ঘটেছে সেটা জানতে হলে দরকার সঠিক তদন্ত। এর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত রয়েছে বা ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে সেই বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে ঘটনাটির আসল রহস্য বের করতে হবে।
তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে জঙ্গিরা জামিনে বের হওয়ার পর তারা হারিয়ে যায়। তাদেরও গোয়েন্দা মনিটরিং করতে হয়। ওই সব জঙ্গিদের মনিটরিং এর মধ্যে না রাখার কারণে ছোট ছোট কিছু ঘটনার মোকাবিলা করতে হয় পুলিশকে। যেটা হলো আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা।
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, আমরা অনেকদিন পর জঙ্গিদের এই তৎপরতা দেখলাম, হয়ত তারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেছে।
তিনি বলেন, জঙ্গিরা বাংলাদেশে সংঘটিত হয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য। হয়ত তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সংকটগুলো দেখতে পায় বা আছে সেই সংকট সুযোগ মতো কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন হামলার সিদ্ধান্ত নেয় বা করার চেষ্টা করে।
তিনি বলেন, জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তাহলে এ সব হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে তবে হামলার আশঙ্কা এখনো এমন পর্যায়ে যায়নি যে নিরাপত্তার হুমকি রয়েছে।
নির্বাচনের আগে জঙ্গিদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ সময় পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার জন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয় এবং অনেক সময় তারা বিভিন্ন দলের হয়ে ব্যবহৃত হয়। দেখা গেছে, যে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দল তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে হয়ত, সেই সুযোগটা তারা কাজে লাগায়। জঙ্গিদের দমন না করে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে তো অবশ্যই জঙ্গি হামলার আশঙ্কা থাকবে। জঙ্গিদের অনেকে ব্যবহার করে এবং তাদের রাজনৈতিক সুরক্ষা দেয় এবং তারা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক মহলে এই সুরক্ষার একটি প্রতিযোগিতা আছে। এখন গোয়েন্দা সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি জঙ্গিদের মাঠে ছেড়ে দেয় তাহলে তো রাজনৈতিক মহলের কিছু অসৎ মানুষ তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করবে এবং সেই সুযোগটা জঙ্গিরা কাজে লাগাতে পারে। জঙ্গিদের ছেড়ে দিলে বাংলাদেশে জঙ্গি বাড়তেই থাকবে এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকবে।
আব্দুর রশীদ আরও বলেন, জঙ্গি দমনে একটি কৌশল হচ্ছে শক্ত প্রতিরোধের মধ্যে রাখা। তাদের দৌড়ের উপরে রাখা। যদি গোয়েন্দারা জঙ্গি বিরোধী অভিযান হালকা করে ফেলে তাহলে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা বেড়ে যাবে, কোনো বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে জঙ্গিদের যদি তদারকিতে এবং নিয়ন্ত্রণ ও দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্ষম না হয়, তাহলে শুধু নির্বাচনের আগে নয়, যেকোনো সময় জঙ্গি হামলার আশঙ্কা থাকতে পারে।
এনএইচবি/আরএ/