অর্থের অপচয়: প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বারবার উপেক্ষিত
অর্থের অপচয় ঠেকাতে সরকার প্রধানের তাগিদ বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় ও জরুরি ছাড়া কোনো প্রকল্প না নেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও সেটি কার্যকর হচ্ছে না। বরং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছে যেগুলো ভুলে ভরা। ফলে সঠিক সময়ে এ সব প্রকল্পের কোনোটিই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কাজ শুরুর আগেই করতে হচ্ছে সংশোধন। তাতে একদিকে সরকারের অর্থের অপচয় হচ্ছে। অন্যদিকে জনগণও প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অথচ প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সবদিক বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের পর থেকে গত ১৪ বছরে বহু অনুশাসন বা নির্দেশনা দিয়েছেন।
গত ১৪ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে সরকার নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে মোটা দাগে বলতে গেলে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র,পায়রা সমুদ্রবন্দর, শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পসহ বহু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যেগুলোর কোনো কোনোটি শেষ হয়েছে, আবার কোনো কোনোটি শেষ পর্যায়ে। এ সব উন্নয়ন কাজ দেশের দেশের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে।
এ সব প্রকল্পের বাইরেও আরও অসংখ্য প্রকল্প নিচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর। কিন্তু এ সব প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়াতেও বিভিন্ন রকম গলদ থাকায় সেগুলো ফেরতও দেওয়া হচ্ছে। এতে সরকারের বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায় চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন শেখ হাসিনা সেনানিবাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্প এলাকাকে বরিশাল জেলার কারখানা, বিঘাই ও পায়রা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা, শীর্ষক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করা হয় ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে। ওই প্রতিবেদন ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যাচাই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রকল্পটি তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তাতে ব্যয় ধরা হয় ৮৫২ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্প প্রস্তাবটি যাচাই করতে ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকল্প মূল্যায়ন যাচাই (পিইসি) সভা করে। তাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসঙ্গতি ধরা পড়ায় সংশোধন করতে বলা হয়। সংশোধন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে তাতে ব্যয় বাড়িয়ে ৯৫২ কোটি টাকা ধরা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও আইডব্লিউএম ২০২২ সালে জুনে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে। তার উপর ভিত্তি করে সাড়ে আট কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণমূলক কাজ করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ১০০ কোটি টাকা বেশি প্রাক্কলন করে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫২ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী কৃচ্ছ্রসাধন কথা বলার পরও এ প্রকল্পে সাত হাজার ২৫৪ লিটার পেট্রোল ও লুব্রিকেন্ট কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। দুই সেট আসবাসপত্র কেনারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন গত ২৪ অক্টোবর আবারও পিইসি সভা করে। তাতে ব্যয় ২৭৫ কোটি টাকা কমিয়ে ৬৭৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৩ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। অন্যান্য কাজ শেষে একনেক সভায় প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হবে। এভাবেই গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটিতে অনুমোদন পেতে ছয় বছর লেগে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদনের সময় অর্থের অপচয় ঠেকাতে ও কাজের কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে হাজার খানেক অনুশাসন বা নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর এ সব অনুশাসন মানতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর নির্দেশনা দেওয়া হয় একনেক সভার অনুশাসনগুলো আবশ্যিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সভায় প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবীক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে বিভাগীয় পর্যায়ে আইএমইডি অফিস স্থাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু চার বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও ফাইলবন্দি হয়ে আছে অফিস স্থাপনের কাজ।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা ফাইল পাঠিয়েছি। অর্থমন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঘুরছে। কতো দিন লাগবে, বলা যাবে না। তিনি বলেন, আমিও চাই দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশটি কার্যকর হোক।
এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আসলে প্রকল্প বাস্তবায়ন জটিল প্রক্রিয়া। বিভিন্ন কারণে সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হয় না। তবে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। আইএমইডি থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে ত্রুটি কোথায়। ধরা পড়লে তা সংশোধনের ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দেওয়ার ব্যাপারেও বলা হচ্ছে। কারণ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা প্রায় মন্ত্রণালয় মানে না। ফলে প্রকল্প অনুমোদনে বিভিন্ন ত্রুটি দেখা যাচ্ছে। বাস্তবায়নও ঠিকমতো হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সাবেক পরিকল্পনা বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো বই আকারে প্রকাশ করে যথাযথভাবে বাস্তবায়নে জরুরিভাবে পদক্ষেপ নিতে বলে। কিন্তু তাতেও তেমন কাজ হচ্ছে না।
সূত্র মতে, ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর যমুনা নদীতে টানেল নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বলা হয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু সেতু বিভাগ ৫ বছরেও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সেই কাজ করতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে ‘মাস্টার প্লান করা হচ্ছে। তবে এখনো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়নি।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় কৃষি মন্ত্রণালয়কে দেশে উৎপাদিত আলুর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিশেষ করে স্কুল ফিডিং এ বিস্কুটের পাশাপাশি আলুর তৈরি খাদ্য সংযোজন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের একটি প্রকল্প অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, ব্যয় প্রাক্কলন ও যাচাই প্রক্রিয়ায় মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও সংস্থাকে সতর্কতা অবলম্বন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
যানজট সৃষ্টি হয় বা দুর্গন্ধ ছড়াই এমন কোনো বর্জ্য সড়কে রাখা যাবে না। এ ব্যাপারে ২০২০ সালের ৩ মার্চ ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট মহাসড়ক বিভাগের প্রকল্প অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন ‘কাজের গুণগতমান বজায় রাখতে হবে।’
শুধু এটি নয়, ৫৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রায় প্রকল্প অনুমোদনের আগে বিভিন্ন ভুল-ভ্রান্তির কারণে বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে। তারপরও অনুমোদন পাচ্ছে না। অথচ সরকারি প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন ও সংশোধনের জন্য সরকার একটি গাইডলাইন করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করা হলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রকল্প তৈরি করে একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলে সরকার তা পাস করবে। কিন্তু সেই গাইডলাইনও অনুসরণ করা হচ্ছে না।
করোনা ধকলসহ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে সংকট দেখা দিয়েছে। তাই ব্যয় কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি-বেসরকারি পর্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলেছেন। বাধ্য হয়ে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে ২০২২ সালে ৩ জুলাই বিদেশ ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ, জ্বালানি ও সম্মানী ব্যয় কমানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তারপরও প্রায় মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে ডিপিপিতে তা মানা হচ্ছে না।
জানা গেছে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। কিন্তু ডিপিপিতে বিভিন্ন ভুল বা অসঙ্গতি ধরা পড়ায় পিইসি সভায় উপস্থাপন করা সম্ভব নয় জানিয়ে গত ৬ নভেম্বর ডিপিপিটি ফেরত দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পে ২০১৯-২০ অর্থবছরের রেট সিডিউল অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।
আবার কোনো কোনো প্রকল্প একনেক সভায় পাস হলেও বিভিন্ন অজুহাতে ঠিক মতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দেখা গেছে, দুই বছরের প্রকল্প সাত বছরেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ রকম একটি প্রকল্প হচ্ছে ‘কারা নিরাপত্তা আধুনিকায়ন, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্রগ্রাম বিভাগ’ প্রকল্প। ২০১৬ সালে অনুমোদন দেওয়া এই প্রকল্পের কাজ দুই বছরে শেষ করার কথা। কিন্তু চার বার সংশোধন করেও সাড়ে পাঁচ বছরেও শেষ করা যায়নি।
এনএইচবি/আরএ/