নিয়ন্ত্রণহীন ওষুধের বাজার, দিশেহারা সাধারণ মানুষ
মগবাজারের আলবেরুনি মেডিকেল হলে বাচ্চার জন্য নাপা সিরাপ কিনতে গিয়েছেন দরিদ্র এক মা। নাপা সিরাপ নিয়ে ২০ টাকা পরিশোধ করতে গিয়েই বাধল বিপত্তি। দোকানি বললেন, ৩৫ টাকা দাম। কিন্তু ওই মায়ের কাছে ২০ টাকাই আছে। ফলে দোকানি ওষুধ না দিয়ে রেখে দিলেন।
ওই মা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সবকিছুর দাম এত বেড়েছে যে আমাদের মতো দরিদ্ররা ওষুধ কিনব কীভাবে? আরও ১৫ টাকা যোগাড় করে তারপর বাচ্চার নাপা সিরাপ কিনতে হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সমালোচনার ঝড় উঠে। এক্ষেত্রে ওষুধ যেন ব্যতিক্রম। নীরবে ওষুধের দাম বাড়লে কোথাও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। অথচ প্রয়োজনীয় সব ওষুধের দাম একটু একটু করে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নানা কারণ দেখিয়ে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে অন্তত ৫৩ ধরনের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে সরকার। কিন্তু এই সুযোগে প্রায় সব ধরনের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো।
২২ নভেম্বর ওষুধ কোম্পানি লিবরা ইনফিউসনের স্যালাইনসহ ২৪ ধরনের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। হাইকোর্টে রিট করে লিবরা তাদের এই ২৪ ধরনের ওষুধের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে।
আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর গত রবিবার (২০ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি বৈঠক হয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সভাপতিত্বে সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস সোসাইটির প্রতিনিধিরা উপস্থিতি ছিলেন।
সভা শেষে সংশ্লিষ্টরা জানান, কাঁচামালের দাম বাড়ায় ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ডলার সংকট ও কাঁচামালের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
লিবরা ইনফিউশন লিমিটেডের ২৪ ধরনের ওষুধের দাম প্রকারভেদে ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ চাপে পড়ে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় আমরা নামমাত্র দাম বাড়িয়েছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর শুধু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ১১৭ ধরনের জেনেরিক ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও আমদানিকারকরা বাড়াতে-কমাতে পারেন। একারণেই ওষুধের দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে।
ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব মো. শফিউজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কাঁচামাল, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহণ ও সরবরাহ ব্যয়, জ্বালানি তেলের দাম, ডলারের বিনিময় মূল্য এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এলসি খুলতে বেশি খরচ হচ্ছে। একারণে ওষুধের দাম কিছু বাড়াতে হয়েছে।
বেসরকারি চাকরিজীবী সাবিহা সুলতানার ডায়াবেটিস আছে। সেই সঙ্গে থাইরয়েড সমস্যা ও উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। বর্ধিত দামে ওষুধ কিনতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।
সাবিহা সুলতানা বলেন, এসকেএফ ফামাসিউটিক্যাল কোম্পানির মিক্সটার্ড ৩০ ইনসুলিন আগে পাওয়া যেত ৩৬০ টাকায়। এখন কিনতে হয় ৪১৫ টাকা দিয়ে। থাইরক্স কেনা যেত প্রতি পাতা ৫৫ টাকায়। এখন কিনতে হয় ৭৫ টাকায়। উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ওসারটিল-৫০ কেনা যেতো প্রতি পাতা ৮০ টাকা। এখন কিনতে হয় ১০০ টাকায়।
রাজধানীর কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন লাগে এমন ওষুধ যেমন এসিডিটি, রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো রোগের ওষুধের দাম সব কোম্পানিই বাড়িয়েছে। দাম ওষুধভেদে ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
মেট্রোনিডাজল ২০০ মিলিগ্রামের দাম ৪০ পয়সা বেড়ে এক টাকা হয়েছে। ২৪ টাকা ১০ পয়সার এমোক্সিলিন বিপি ৫০০ মিলিগ্রাম ইঞ্জেকশনের দাম বেড়ে ৫৫ টাকা হয়েছে। জাইলোমেট্রোজালিন, প্রকোলেপেরাজিন, ডায়াজেপাম, মিথাইলডোপা, ফেরোসের মতো জেনেরিকের দাম ৫০ থেকে শতভাগ বেড়েছে।
জ্বরের জন্য নাপা ৫০০ মিলিগ্রাম প্রতি পিস ট্যাবলেট ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে ১ টাকা ২০ পয়সা হয়েছে। প্রতি পিস নাপা এক্সটেন্ড দেড় টাকা থেকে ২ টাকা হয়েছে।
এনএইচবি/আরএ/