ছাত্রলীগের জয়-লেখক কতটা সফল?
বহু প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদে জয়-লেখককে দায়িত্ব দেওয়া হলেও খুব একটা সুফল পায়নি সংগঠনটি। নেতা-কর্মীরা বলছেন, শুরুতে তাদের নিয়ে ভাল প্রত্যাশা থাকলেও পরবর্তী সময়ে তাদের কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অনেক নেতাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
দায়িত্ব পাওয়ার পর জয়-লেখক তাদের কর্মকাণ্ডে কতটুকু জয়ী হয়েছেন তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন! শেষ সময়ে এসেও বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা জয় ও লেখকের। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ভালো কাজের পাশাপাশি প্রেস রিলিজ নির্ভর কমিটি দিয়ে তারা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে আর্থিক লেনদেনেরও।
আগামী ৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন। এর মধ্যে সম্মেলনকে ঘিরে পদপ্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। এ দৌড়-ঝাঁপের সময়েও শেষ মুহূর্তে এসে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি দিয়েই চলছেন তারা। ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকাপ্রকাশ জানার চেষ্টা করেছে জয়-লেখক কতটা সফলতা অর্জন করেছেন কিংবা ব্যর্থতাই বা কতটুকু।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের সর্বশেষ ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ পদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পান শোভন-রাব্বানী। এর দুই মাস পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ গঠিত হয়েছিল। দুই বছর মেয়াদী ওই কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের মেয়াদ শেষ হবার কথা ছিল ২০২১ সালের ৩১ জুলাই। এক বছরের মাথায় চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সংগঠনের শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং বিতর্কমুক্ত করতে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এক নম্বর সহসভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কে সভাপতি ও এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে দুই শীর্ষ নেতাকে ‘ভারমুক্ত’ করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঠিক তখন থেকেই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন জয়-লেখক। এই অভিযোগ খোদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতার।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগের ১৫ ধারার (ঙ)-তে বলা আছে, প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা বসবে। অন্য সব নিম্নতম শাখায় নির্বাহী সংসদের সভা বসবে প্রতি মাসে অন্তত একবার। এ হিসেবে জয়-লেখক কমিটির তিন বছরে দুই মাস পরপর ১৮টি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা, সেখানে হয়েছে মাত্র একটি।
গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগের ১১ ধারার (খ)-তে বলা আছে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল দুই বছর। এ সময়ের মধ্যে সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী সংসদের কার্যকারিতা লোপ পাবে। এটিও পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন জয়-লেখক। এ নিয়ে নানান সময়ে কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তারা।
ব্যর্থতা নিয়েই সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে জয়-লেখক অধ্যায়ের!
সম্মেলনের বাকি আর মাত্র কয়েকদিন, শেষ সময়ে এসেও কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া ঘোষণা করা হচ্ছে বিভিন্ন শাখা কমিটি। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ থেকে নিষেধ করা হয়েছে সম্মেলনের আগে ছাত্রলীগের কোনো শাখা কমিটি না দেওয়ার জন্য। এমনটাই জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। সেই নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে নতুন নতুন কমিটি দিয়েই চলছেন এ শীর্ষ দুই নেতা। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এসব সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন জেলায় চলছে বিক্ষোভ ও অগ্নিসংযোগ।
নেতা-কর্মীদের প্রত্যাশা আগামী ৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসবে। যাদের হাত ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের চিরচেনা ঐতিহ্য ফিরে আসবে। প্রত্যাশা পূরণে কাজ করে যাবেন নতুন নেতৃত্ব।
সম্মেলন ছাড়াই কমিটি
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের জেলা ইউনিট ১১১টি। যদিও তাদের সময়ের মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বাড়লে ১১৯টি ইউনিট কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৮টি কমিটি দিতে পেরেছেন তারা। বাকি রয়েছে ৮১টি কমিটি। গঠনতন্ত্রে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণার কথা থাকলেও হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া প্রত্যেকটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে। এর মধ্যেও রয়েছে বিতর্ক। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, কারও সঙ্গে কোনো পরামর্শ ছাড়া তার নিজ খুশি মতো কমিটি ঘোষণা করেন।
এদিকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ ২৫১টি। তবে ২৮তম কাউন্সিলে সোহাগ-জাকির কমিটির সময় থেকে সেটি বাড়িয়ে করা হয় ৩০১টি। শোভন-রাব্বানীর সময়ে হওয়া কমিটির এসব পদের প্রায় শতাধিক নেতা চাকরি, ব্যবসা কিংবা বিয়ে করায় সেই পদগুলো খালি হয়। সেটি পূরণ হয় গত আগস্টে। তবে বিতর্কিত ও ঘনিষ্ঠজনদের পদায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে জয়-লেখকের বিরুদ্ধে।
আর্থিক লেন-দেনের অভিযোগ
বিভিন্ন কমিটি দেওয়ার সময় আর্থিক লেন-দেনের অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। অনেক সময় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতাসহ স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন যে ‘টাকার বিনিময়ে পদ’ দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে য়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়।
সফলতা না ব্যর্থতা, কোনটার পরিমাণ বেশি
মানবিক কার্যক্রম জোরদার করে অক্সিজেন সেবা, অসহায়দের জন্য খাদ্য সহায়তা, করোনায় মৃতদেহ দাফন, কৃষকের ধান কেটে দেওয়াসহ মানবিক কাজে এগিয়ে থাকলেও সাংগঠনিক কাজে গতি ফেরাতে পারেননি জয়-লেখক। প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন তারা।
এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সোহান খান বলেন, আমাদের যে গঠনতান্ত্রিক কাঠামো, দুই বছর পার হলেও সারা বাংলাদেশে প্রেস কমিটিটে সয়লাব। যা আমাদের ব্যথিত করেছে।
তিনি আরও বলেন, জয়-লেখক নিয়ে নেত্রীর প্রত্যাশা থাকলেও, তাদের ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সেই প্রত্যাশা পূরণে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মিটিং, দায়িত্ব বণ্টনেও বিভিন্ন অজুহাতে বিলম্ব হয়েছে।
আসন্ন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের বিষয়ে জয়-লেখকের ভূমিকা কতটুক জানতে চাইলে সোহান খান বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের মে মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলনের কথা বললেও তারা (জয়-লেখক) কর্ণপাত করেননি। তখন তাদের কথা ছিল, নেত্রী যেদিন বলবেন সেইদিন ছাত্রলীগের সম্মেলন হবে। আসলে ছাত্রলীগের সম্মেলন কখনো নেত্রী ঘোষণা করেন না। এটা সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। তবে সম্মেলন হওয়া নিয়ে নিষ্ক্রিয়তা ছিল তাদের।’
এদিকে, শেষ সময়ে এসে প্রেস-রিলিজ কমিটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলে, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সম্মেলনের দিন পর্যন্ত তারা জেলা-উপজেলা কমিটি দেওয়ার এখতিয়ার রাখে। তবে অতি সাম্প্রতি তারা যেভাবে কমিটি দিয়েছেন তা গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এভাবে তাদের কমিটি গঠন করা উচিত হয়নি।
জয়-লেখকের এ কমিটির মূল্যানের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি বলেন, ‘আপনি কি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বিষয়ে মূল্যায়ন করতে পারেন; না, পারেন না?.. ‘করোনা মহামারিকালীন সারা বাংলাদেশের ছাত্রলীগ যেভাবে কাজ করেছে তা অসাধারণ। তবে সামনে যারা নেতৃত্ব আসবে তাদের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে তারা কেমন ছিলেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আমাদের আরেকটু ভালো করার সুযোগ ছিল। জীবনে তো আর সবসময় শতভাগ আউটপুট নেওয়া যায় না, তবে যথেষ্ট ভালো করছেন তারা। আরেকটু সমন্বয় করতে পারলে ভালো হতো। এ ছাড়া, দুয়েকজন যারা বিদ্রোহী বা বিরোধিতা করছে তাদেরকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা যেত, তাহলে বিষয়টি ভালো হতো।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের আরেক সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ বলেন, বিগত ৫ বছর যদি মূল্যায়ন করা হয়, সে বিবেচনায় আনলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক গতি অনেকটাই মন্থর হয়ে গিয়েছিল। সেভাবে বিগত পাঁচ বছর ছাত্রলীগকে গতিশীল করা হয়নি। ১১৯টি ইউনিটের মধ্যে কদাচিৎ ৪/৫ টি জেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে তারা (জয়-লেখক) কমিটি দিলেও বাকিগুলোতে সম্মেলন না করেই তারা প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি দিয়েছেন। এ ছাড়া, স্বেচ্ছাচারীতা, সংগঠনে একনায়কতন্ত্র বজায় রাখা এগুলো নিয়ে সব সময়ই কথা উঠেছে।
‘তাহলে কি জয়-লেখকের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পরিমাণে বেশিই’ বলে মনে হয় কি না জানতে চাইলে ইয়াজ আল রিয়াদ বলেন, ‘সেটি তো কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। সাংগঠনিক কার্যক্রমে তাদের ব্যর্থতা সেটি মুখ্য বিষয়। সেই জায়গাতে ব্যর্থতার পরিমাণই বেশি।’
এদিকে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাদের পাওয়া যায়নি। তবে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টিও জয়-লেখকের নতুন না!
এনএইচবি/এমএমএ/