‘দানব’ হয়ে ওঠা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গলদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা
দানব হয়ে উঠছে ডেঙ্গু। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে প্রতিদিন। হঠাৎ করে ডেঙ্গুর এমন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেজ্ঞরা।
তারা মনে করছেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে গলদ রয়েছে। শুধু মশক নিধনকর্মীদের উপর নির্ভরশীল না থেকে মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে স্বেচ্ছাসেবীদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ, পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ দেওয়া ও হটস্পট ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো সফল করতে পারলেই শুধু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যেই অক্টোবরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমে সেই অক্টোবরেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সবচেয়ে বেশি ৮৬ জন। নভেম্বরের সাত দিনেই মারা গেছেন ৩৬জন মানুষ। কাজেই ডেঙ্গুর গতিপ্রকৃতিও পরিবর্তিত হয়ে শক্তিশালী হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা নানা তৎপরতা শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ ছিটানো, সরকারি অফিসের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল, বিনামূল্যে অ্যারোসল বিতরণ এবং সেলিব্রেটিদের সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করা ইত্যাদি। কিন্তু এসব উদ্যোগ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই অভিযোগ অনেকের।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই কলকাতার উদাহরণ টেনে বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতায় নেওয়া পদক্ষেপের দিকে তাকালে এবং একই রকম পদক্ষেপ নিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ভয়াবহতা প্রশমিত হতে পারে। কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে, সিটি করপোরেশনের ২০ থেকে ২৫ জন কর্মচারী রয়েছে। যাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচারের কাজ চালায়, অন্যরা পানি জমে আছে কি না সেদিকে নজর রাখে। কোথাও ডেঙ্গু হলে তারা খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছে এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
করপোরেশনের মনিটরিং কর্মীরা পানি জমে আছে এমন ভবনকে ১ লাখ রুপি পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন এমন আইন করা হয়েছে। কলকাতার এই উদ্যোগ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করছে বলেই দাবি সংশ্লিষ্টদের।
কিন্তু ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম মূলত মশক নিধনকর্মীদের উপর নির্ভরশীল। যদিও কিছু ব্যতিক্রমও আছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম মাঝে মাঝে নগরবাসীদের সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ করছেন। কিন্তু আদতে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবীদের সংযুক্ত করে এডিস নিধনের কাজ করলে সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের একটি বড় শক্তি হলো জাতীয় দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার লোকের অভাব নেই। অতীতে বহুবার দেখা গেছে কীভাবে মানুষ বিভিন্ন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে। এই স্বেচ্ছাসেবকদের ডেঙ্গুর উৎস নির্মূলের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। সরকার উদ্যোগ নিলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এ কাজে আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করবে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলামও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এডিস নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততার তাগিদ দিয়ে বলেন, এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার সরকারি প্রচেষ্টায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকাপ্রকাশে-কে বলেন, মশক নিধনে দুই সিটি করপোরেশন মুলত মশক নিধন কর্মীদের উপর নির্ভরশীল। অথচ পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ নাই। আগে তো একেবারেই ছিল না। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হওয়ার পর হাতেগোণা কয়েকজন কীটতত্ত্ববিদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই পরিচালক বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যপকমাত্রায় জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে না পারলে এক্ষেত্রে আদৌ সফলতা আসবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব এলাকায় এক সঙ্গে মশা নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশন ওয়ার্ডভিত্তিক মশক নিধন কার্যক্রম গ্রহণ করে।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, একক কোনো পন্থা দিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। একাধিক পন্থায় কাজ করতে হবে। একসঙ্গে যদি সব এলাকায় মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় তাহলে এটি সুফল বয়ে আনবে।
আরেকটি বিষয় হলো হটস্পট ব্যবস্থাপনা। হটস্পট ধরে ক্রাশ প্রোগ্রাম করার তাগিদ দেন সংশ্লিষ্টরা। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, কোনো বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলে আশেপাশে আধা কিলোমিটার এলাকায় যাতে উড়ন্ত মশা না বেঁচে থাকে সেই ব্যবস্থা করা। কিন্তু এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের এমন উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, হটস্পট ধরে ক্রাশ প্রোগ্রাম করতে হবে। এসব হটস্পট ব্যবস্থাপনায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
এনএইচবি/এমএমএ/