৯ বছরেও শেষ হয়নি উপকূল রক্ষা বাঁধের কাজ, ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব!
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হলেই ভেসে যায় উপকূলীয় অঞ্চল। এতে প্রাণহানির ঘটনা কমে এলেও ফসল এবং ঘর-বাড়ি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে উপকূলীয় ১৩ জেলায় ১০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ছয় হাজার হেক্টরেরও বেশি জমির। আর এক হাজার খামারের মাছ ভেসে গেছে।
উপকূলের মানুষকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, লবণ পানি, বন্যা আর ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকার ২০১৩ সালে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিল। পটুয়াখালীসহ ছয় জেলার জীবন, ফসল ও প্রাণিসম্পদ রক্ষা করার এ প্রকল্পটির কাজ গত নয় বছরেও শেষ হয়নি। অথচ এটি শেষ করার কথা ছিল ২০২০ সালে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধন করে গত জুনে শেষ করার কথা ছিল। সেটিও সম্ভব হয়নি। তবে দীর্ঘ নয় বছরে প্রকল্পের সাত জন প্রকল্প কর্মকর্তা (পিডি) বদল হয়েছে। আর কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ ও আর্থিক অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। এই অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর বাড়ানো হচ্ছে। একইসঙ্গে শেষ সময়ে এসে পরামর্শকের ব্যয় ১৫ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অবশ্য পরিকল্পনা কমিশন এতে আপত্তি জানিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে এ সব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে ‘উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প প্রথম পর্যায়-১ (সিইআইপি) শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক।
সিইআইপি প্রকল্পের প্রথম প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সারাফাত খান। এরপর পিডির দায়িত্ব নিয়েছেন ছয় জন। ৭ম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সাইদ হাসান ইমাম।
সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকৌশলী সাইদ হাসান ইমাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। টিম লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে বিদেশি প্রকৌশলী ও পরামর্শক। ১৭টি পোল্ডারের মধ্যে ১০টির কাজ চলছে। আগামী জুনে পুরো কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
প্রকল্পের কাজ শেষ করতে এত দেরি কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে আমি সাত নম্বর পিডি। এর আগে ছয় জন দায়িত্ব পালন করেছেন। দেরির কারণ তারা বলতে পারবেন। আমি এক বছর হলো দায়িত্ব নিয়েছি। আসলে পিডি হিসেবে তেমন কাজ নেই। টিম লিডারের কাজই প্রধান। বিশ্ব ব্যাংকের শর্ত মোতাবেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানই সেই দায়িত্ব পালন করছে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে ঘন ঘন পিডি বদলের কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়েছে বিষয়টি তা না। কারণ কারো পদোন্নতি হয়, অনেকের চাকরির মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। দেরির কারণ মূলত ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা। অধিগ্রহণকৃত জমি জেলা প্রশাসন থেকে ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে পারেনি। করোনাকালে কাজও হয়নি। এ জন্য কিছুটা দেরি হয়েছে। আশা করি, এবার সংশোধন করে সময় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাতে কাজ শেষ হয়ে যাবে। আবার ফেজ-২ নামে আরও একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। এজন্য ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজও করা হচ্ছে।’
পরিকল্পনা কমিশন ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা সরকার ২০১৩ সালের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে তার মধ্যে এটি মেগা প্রকল্প।
উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালি জেলার ১৭টি স্থানে পোল্ডার নির্মাণ করে বসবাসের উপযোগী করা ছাড়াও চাষাবাদযোগ্য রক্ষার কথা বলা হয়েছিল। পোল্ডার এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে কারিগরি দিক, পরিবেশ, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগলিক দিক বিবেচনায় নিয়ে।
এতে খুলনা জেলায় ৬টি, সাতক্ষীরায় ২টি, বাগেরহাটে ৩টি, পিরোজপুরে ১টি, বরগুনায় ২টি এবং পটুয়াখালী জেলায় ৩টিসহ মোট ১৭টি পোল্ডার নির্মাণ করার কথা। যাতে নির্ধারিত উপকূলীয় এলাকার জনবসতির জীবন, সম্পদ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও রক্ষা পাবে। প্রকল্প এলাকায় বাণিজ্যিক বনায়নেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়। একই সঙ্গে পোল্ডার এলাকায় অগভীর চিংড়ি ঘেরও তৈরি করা হবে।
বাঁধ রক্ষা করাই এ প্রকল্পের প্রধান কাজ। কারণ, পোল্ডার এলাকার বাঁধ রক্ষা না করা গেলে কোনো উন্নয়নমূলক কাজই করা যাবে না। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলার মতো যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পোল্ডার এলাকাগুলো রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। এ ছাড়াও অপেক্ষাকৃত নিচু উপকূলীয় এলাকাগুলোকে উঁচু করারও সিদ্ধান্ত হয়।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজ ধরা হয় ৬টি জেলার উপকূলীয় এলাকায় এক লাখ ৮১৭ হেক্টর জমি নদীর গ্রাসের হাতে থেকে উদ্ধার। ৮০ হাজার ৫৭৪ হেক্টর জমি আবাদযোগ্য করে তোলা ও পোল্ডার এলাকায় প্রায় ৭ লাখ ৬২ হাজার ৯৬০ জনকে পুনর্বাসন। কারণ ২০৫০ সালে উপকূলীয় জনবসতির সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা থাকলেও সময় করতে না পারায় ব্যয় ঠিক রেখে সংশোধন করে দুই বছর সময় বাড়ানো হয় ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারিতে। সে অনুযায়ী ২০২২ সালের জুনে শেষ করার কথা। কিন্তু তাতেও কাজ শেষ না হওয়ায় এবারও ব্যয় ঠিক রেখে সময় দেড় বছর বাড়ানো হচ্ছে।
প্রস্তাবনাটি যাচাই করতে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকার বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমাতে বললেও পরামর্শক খাতে ব্যয় ৪০৭ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২২ কোটি টাকার প্রস্তাব করেছে। অর্থাৎ ১৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে। এই ব্যয় অত্যধিক বলে পিইসি সভায় আপত্তি তুলে ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যয় কমিয়ে কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এক কিলোমিটার বাঁধ উন্নয়নের কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পিইসি বলেছে, এ সব সংশোধন করা হলে প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে।
এনএইচবি/আরএ/