ফরিদপুরের পর্দা কেলেঙ্কারির নায়ক এবার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে!
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অনিয়ম-দুর্নীতি রীতিমত জেঁকে বসেছে। এবার একটি মেশিন নিয়ে চলছে নানা তেলেসমাতি। হাসপাতালের আগের পরিচালক জার্মানির তৈরি মেশিন নিয়েছিলেন। আর বর্তমান পরিচালক সেটিকে বিদায় দিয়ে নিজের পছন্দের কাউকে রি-এজেন্ট করতে চায়নিজ মেশিন ঢুকিয়েছেন হাসপাতালে। সেই মেশিন আবার সরবরাহ করেছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারির হোতা মুন্সি সাজ্জাদ হোসেন। আর এই মেশিন কেলেঙ্কারিতে ত্রাহি অবস্থা সেবা নিতে আসা রোগীদের।
জানা গেছে, বিশেষ স্বার্থ হাসিলের জন্য ডাইমেনশন আরএক্স মেশিন যেটি বর্তমানে সচল রয়েছে, সেটি বাইরে ফেলে রেখে চীনের তৈরি একই মেশিন হাসপাতালে ঢুকিয়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিতর্কিত এক ঠিকাদারের মাধ্যমে চীনা এই মেশিনটি আনিয়েছে। অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সিন্ডিকেট ভাঙতেই এটা করা হয়েছে।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে নতুন এই মেশিন বসানোর পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ভুল রিপোর্ট আসছে।
জানা গেছে, জার্মানির তৈরি মেশিন দেশের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে নির্ভুলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করেই সচল মেশিনটি বারান্দায় ফেলে রেখে নতুন মেশিন বসিয়েছে। এ নিয়ে খোদ হাসপাতালের ভেতরেই বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কানাঘুষা চলছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি বিশেষ মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই চীনের মেশিন হাসপাতালে ঢুকিয়েছে।
জার্মানির তৈরি ডাইমেনশন আরএক্স মেশিনটি সচল থাকা সত্ত্বেও বারান্দায় ফেলে রেখে নতুন যে চাইনিজ মেশিনটি বসানো হয়েছে তাতে টিএসএইচ এবং এফটি-৪ রিপোর্টে ভুল এসেছে। এ ছাড়া ক্রিটিনিন পরীক্ষাতেও ভুল রিপোর্ট এসেছে। যা রোগীর জন্য মারত্নক ক্ষতি হতে পারত। এনিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কয়েক দফা মিটিংও করেছে।
গত ২৮ জুলাই শারমিন নামের এক রোগীর টিএসএইচ পরীক্ষা করা হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবে। সেখানে টিএসএইচ ০.২৪ এবং এফটি-৪ ফলাফল দেখানো হয়েছে ১৭.০। ডাক্তার সেই রিপোর্টকে ভুল বলায় নতুন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা করানো হয়। সেখানে এফটি-৪ ফলাফল আসে ১৩.৭৮ এবং টিএসএইচ রিপোর্টে ফলাফল আসে ৩ দশমিক ৯৬। এটা ওই রোগীর জন্য মারাত্নক ক্ষতি হতে পারত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জার্মান মেশিনটি গিফটের। এই মেশিন গিফট দেওয়ার পেছনে বড় কারণ রি এজেন্ট ব্যবসা। অর্থাৎ যতদিন এই মেশিন এখানে থাকবে ততদিন ওই প্রতিষ্ঠান এখানে রি-এজেন্ট দিতে পারবে। এতে করে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেও সফল হবে।
অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠান এখন রি-এজেন্ট ব্যবসা করছে তাদেরকে তাড়িয়ে নতুন ঠিকাদার সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালে মেশিনারিজ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। সে জন্য তারা চায়নিজ একটি মেশিন সরবরাহ করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত জাতীয় বক্ষব্যাধী হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সি সাজ্জাদ হোসেন ডাইমেনশন আরএক্স মেশিন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সরবরাহ করতে চান। তিনি চাকরির পাশাপাশি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
জার্মান মেশিনের বদলে চায়নিজ যে যন্ত্রটি উঠানো হয়েছে তার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাহিদা এন্টারপ্রাইজ ও এসএল ট্রেডার্স নামে দুটি প্রতিষ্ঠান এই যন্ত্র সরবরাহ করেছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই মুন্সি সাজ্জাদ হোসেনের পরিবারের সদস্যদের। তাদের কাছে চাহিদা ছিল জার্মানির মেশিনের। কিন্তু তারা সেটি না দিয়ে চায়নিজ মেশিন সরবরাহ করেছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বাৎসরিক চাহিদাপত্র থেকে জানা গেছে, পরীক্ষা নিরীক্ষার এই যন্ত্রটির জন্য যে টেন্ডার করা হয়েছিল তার গ্রুপ নং-৪ কেমিক্যাল রি-এজেন্ট। (সূত্র স.ম.ক.হ: এমএসআর ও বিবিধ/২০২১/২০২২/২৫৬১। তারিখ ২১.০৯.২০২১।) দরপত্র দাখিলের তারিখ ২৫.১০.২০২১। বাজেট ২০২১-২০২২ অর্থবছর।
দেশের ৮০ ভাগ হাসপাতালে জার্মানির এই মেশিন রয়েছে বলে জানিয়েছেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মো. মইনউদ্দিন রুবেল। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমার মেশিন সচল, তারা সেটা বাইরে ফেলে রেখেছে। কিন্তু কি কারণে মেশিন বাইরে ফেলে রাখা হয়েছে তা তিনি জানেন না।
তবে এই অভিযোগ মানতে নারাজ শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙতেই এটা করা হয়েছে। দুইটা মেশিনের একটা মেশিন অচল আর একটা চালু আছে। জার্মানি মেশিনের কথা বলে সিন্ডেকেট করে সরকারের যে টাকা অপচয় করেছে তারা সিঙ্গেল অথরাইজেশন এনে সেটা ভাঙতেই এটা করা হয়েছে। জার্মানির যে রি-এজেন্টের দাম ১০ টাকা, সেটা তারা ১০০ টাকা করেছে, বাধ্য হয়ে তাদের কাছে যেতে হতো। এতো উচ্চমূল্যে আমরা কিনতে পারি না। বাধ্য হয়ে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন তারা পায়নি বলে একটু রিউমার তো দেবেই। আমরা তো জনগণের স্বার্থে কাজ করেছি।
নতুন মেশিনে যে ভুল রিপোর্ট এসেছে, এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমতা আমতা করে এই পরিচালক বলেন, ‘ভুল কোনো ই না, যে কোন ভুল অ্যা… অ্যা…। এখন আগের চেয়ে পরীক্ষার হার কত বেড়েছে, ২০ গুণ পরীক্ষা বেড়েছে। আগের পরিচালক হাই দামে কিনে জার্মানি ঢুকিয়েছেন।’
অনেক পরীক্ষা হয় না এ বিষয়ে তিনি বলেন, রি-এজেন্ট শেষ হলে টেন্ডার ছাড়া তো আনতে পারি না।
সরকারি ক্রয় বিধিমালা না মেনে এটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালায় (পিপিআর) ২০০৮- এ বলা আছে, টেন্ডারে কোম্পানির নাম উল্লেখ করতে পারবেন না। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘হিউম্যান’ উল্লেখ করে দিয়েছে। এটা ওই কোম্পানির ব্রান্ডের নাম। সাধারণত টেন্ডারে দেশের নাম উল্লেখ করে দেওয়া হয়। এখানে সেই বিধিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত রয়েছে। এদের মধ্যে স্টোর কিপার দেলোয়ার হোসেন, জাকির এবং ফার্মাসিস্ট আমিনুলও যুক্ত আছেন।
অভিযোগের বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘মেশিন ঢুকছে কথা সত্য। চায়না মেশিনও ঢুকছে, জার্মানিরটাও ঢুকছে। হিউম্যানের যে চায়না মেশিন ঢুকছে সেটা সত্য। তবে আমার জড়িত থাকার যে অভিযোগ সেটা একদমই সত্য না‘।
জানতে চাইলে মুন্সি সাজ্জাদ হোসেন সাহিদা এন্টারপ্রাইজ ও এসএল ট্রেডার্স দুটিই তার প্রতিষ্ঠানই স্বীকার করে বলেন, ‘আমি মেশিন সরবরাহ করিনি। আমি এমএসআর প্রোডাক্ট সরবরাহ করেছি। এখানে মেশিন সরবরাহ করেছে আলম নামে একজন।’
এনএইচবি/আরএ/