১৫ আগস্ট: ৩ মামলার কূল-কিনারা হয়নি ২৬ বছরেও
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পাশাপাশি ধানমন্ডিতে শেখ ফজলুল হক মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও আক্রমণ চালায় এবং তাদেরও হত্যা করে বিপথগামী সেনাসদস্যরা।
আর ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের সময় কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডে মারা যান আরও ১৩ জন সাধারণ মানুষ।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার বিচারকার্যক্রম শুরু হয়। বিচারিক সব পর্যায় পেরিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে খুনিদের কয়েকজনের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। শুধু যারা পালিয়ে আছে তাদের ফাঁসি এখনো কার্যকর হয়নি।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হলেও একই সময়ে ঘটে যাওয়া অন্য তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বিচারকাজ গত ২৬ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি বিচারিক আদালতে।
আবদুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলা
মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলা চালায় বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য। বাসার ভেতরে ঢুকে হামলাকারী সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, আজিজ পাশা ও নুরুল হুদা অস্ত্রের মুখে বাসার সদস্যদের ড্রয়িংরুমে জড়ো করে ব্রাশফায়ার করে আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ আটজনকে হত্যা করে।
নিহতরা হলেন- আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, চাচাতো ভাই শহীদ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত হাসানাত বাবু (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে), গৃহপরিচারিকা লক্ষ্মীর মা ও গৃহপরিচারক পোটকা ও আবদুর রহিম খান রিন্টু।
এই আট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আবুল হাসানাতের স্ত্রী শাহান আরা বেগম বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২১ অক্টোবর রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় মেজর শাহরিয়ার, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা হিরুকে আসামি করা হয়।
পরের বছর ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলাটি ঢাকা প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।
এই মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার দুলাল ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম বছরের পর বছর বন্ধ রয়েছে। চার্জশিট দাখিলের পর থেকে বিচারিক কার্যক্রম আর এগোয়নি।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর হওয়ায় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে অনেকের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তবে কয়েকজন এখনো পালিয়ে আছেন।
শেখ ফজলুল হক মনি হত্যা মামলা
এই মামলা এজহার সূত্রে জানা গেছে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ ফজলুল হক মনির ধানমন্ডির বাসায় ২৫-৩০ জনের একটি দল আক্রমণ চালায়। আক্রমণে তারা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে খুন করে।
এ ঘটনায় সাবেক উপমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ ১৬ জনকে আসামি করে ১৯৯৬ সালের ২০ নভেম্বর ধানমন্ডি থানায় মামলা হয়। কিন্তু এই মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি ২৬ বছরে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই মামলার নথিই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মর্টার হামলা মামলা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের উদ্দেশে কামানের যে গোলা ছোড়া হয়েছিল তা গিয়ে মোহাম্মদপুরে শেরশাহ সুরি রোডের ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়িতে (বস্তি)। গোলার আঘাতে নিহত হন ১৩ জন। ওই ঘটনায় আহত হন প্রায় ৪০ জন।
নিহতরা হলেন— রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, ময়ফুল বিবি, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ার বেগম নামের দুইজন, হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, আমিন উদ্দিন আহম্মেদ ও শাহাব উদ্দিন আহম্মেদ।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রায় দশ বছর পর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় এই মামলার আসামিদের কয়েক জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। অন্য আসামিদের কেউ কেউ পলাতক রয়েছেন।
বর্তমানে ঢাকার মহানগর চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। আলোচ্য তিনটি মামলার মধ্যে তুলনামূলক এই মামলার কার্যক্রম কিছুটা এগিয়েছে। এ মামলায় ৫৮ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে বলে ঢাকাপ্রকাশ’কে জানান সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হেলাল। তিনি জানান, এই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৩ আগস্ট দিন ধার্য আছে।
গত দুই বছরে এই মামলার কোনো অগ্রগতি নেই— এমন প্রশ্নের জবাবে এই আইনজীবী বলেন, আদালত থেকে সমন পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সাক্ষীরা যদি না আসেন, তাহলে আমাদের কী করার আছে? অনেক আসামি মারা গেছেন, তাদের মৃত্যুর খবর এলে আমাদের তো সমন্বয় করা ছাড়া আর কাজ থাকে না।
এনএইচবি/আরএ/