সরকারি নিয়মনীতি পাত্তা দেন না ডা. মুজিবুর!
রূপা আক্তার নামে এক মহিলা নিজের নবজাতক শিশুকে নিয়ে মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে যান ডা. মুজিবুর রহমাানের কাছে। কিন্তু গেটে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী মো. সাঈদ তাকে বলেন, ‘মুজিবুর রহমান স্যার তো হসপিটাল থেকে বের হয়ে গেছেন। আগামীকাল সকাল দশটার পর আসেন, তাহলে স্যারকে পাবেন। (এই ঘটনাটি গত সোমবার (৮ আগস্ট) দুপুর ১টা ১০মিনিটের)।
এ কথা শুনে রূপা যখন চলে যাচ্ছিলেন সাঈদ তখন রূপার স্বামী রহিম মিয়াকে কানে কানে বলেন, জরুরিভাবে দেখাতে চান তাহলে নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁও চলে যান, সেখানে স্যার আছেন। মুজিবুর রহমানের মোবাইল নাম্বার রহিমকে দিয়ে সাঈদ বলেন, সেখানে গিয়ে আমার কথা বলবেন। স্যার ভালোভাবে আপনার শিশুকে দেখে দিবেন।
তাসলিমা বেগম নামের আরেক মহিলা তার শিশু কন্যাকে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ মুজিবুর রহমান সাহেবকে দেখাতে এসেছি। দুদিন ধরে আসছি, কিন্তু তাকে পাইনি। তিনি সময় মতো হাসপাতালে থাকছেন না। অনেকে বলছেন, তার সঙ্গে দেখা করতে হলে নারায়ণগঞ্জ অথবা যাত্রাবাড়ীতে যেতে হবে।’
রূপা বা তাছলিমার মতো আরও অনেকে তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আসলেও ডা. মুজিবুর রহমানের দেখা পান না।
বরং মুজিবুর রহমান যেসব হাসপাতালে বসেন সেখানে রোগীদের পাঠিয়ে দেন তার লোকজন। বিনিময়ে তারা কমিশন পান।
মূলত এই হাসপাতালের গার্ডসহ আরও অনেকেই হলেন-ডা. মুজিবুর রহমানের কমিশন দালাল। এই দালালেরা ডা. মুজিবুর রহমানকে বিভিন্ন রোগী ধরে দেন এবং তা থেকে নিয়মিত কমিশন নেন।
ডা. মো. মুজিবুর রহমান মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং নবজাতক (এনআইসিইউ) বিভাগের প্রধান। কিন্তু তিনি সরকারি নিয়মনীতির পাত্তাই দেন না।
কিন্তু শিশু বিভাগের মতো জরুরি একটি বিভাগের প্রধান হলেও তাকে কখনই হাসপাতালে পাওয়া যায় না। বলা যায়, তিনি হাসপাতালে থাকেন না। সকালে এসে হাজিরা দিয়েই তিনি বের হয়ে যান তার নিজের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। সেগুলোতে বসেই তিনি রোগী দেখেন। আর মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে তার নিজস্ব লোকজন রোগীদের বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেন মুজিবুর রহমানের নিজের প্রতিষ্ঠানে।
তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেন ওই হাসপাতালের ড্রাইভার নজরুল ইসলামের ছেলে মো. ইমরান। ডাক্তার মুজিবুর রহমানের কাছে বিষয়ে ইমরানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে সম্প্রতি ডা. মজিবুর রহমানের যাত্রাবাড়ী ডেল্টা হেলথ কেয়ার, মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ নবজাতক হাসপাতাল ও যাত্রাবাড়ী ডায়গনস্টিক সেন্টার হাসপাতাল লিমিটেডে খোঁজ খবর নিয়ে তার বিরুদ্ধে উঠা বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
কে এই ডা. মুজিবুর রহমান
ডা. মো. মুজিবুর রহমান মাতুয়াইলে শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি শিশু, কিশোর ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেই ইউনিটের ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করছেন। মুজিবুর রহমান সরকারি একজন কর্মকর্তা। কিন্তু সরকারি চাকরি করেও তিনি নিজেই গড়ে তুলেছেন একাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক।
সরজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডা. মুজিবুর যাত্রাবাড়ীর ডেল্টা হেলথ কেয়ার হাসপাতালের একজন প্রভাবশালী পরিচালক। সেখানে প্রতিদিন নিয়মিত রোগী দেখেন। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়ায় সোনারগাঁ কমপ্লেক্সের ইশা খাঁ হসপিটালেও নিয়মিত রোগী দেখেন।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সাইনবোর্ড এলাকায় নিজের স্ত্রী মাহবুবা সুলতানা আসমাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে বাংলাদেশ নবজাতক হাসপাতাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন মুজিবুর রহমান। সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তিনি নিজে।
এ ছাড়া, ধোলাইপাড় গীত সংগীত সিনেমা হলের উল্টো দিকে নিউ ডেল্টা কেয়ার নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানেও নিয়মিত বসেন ডা. মুজিবুর রহমান।
জানা গেছে, নিজের সরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগী দেখা এবং অন্যান্য কাজ ফেলে মুজিবুর রহমান নিয়মিত তার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সময় দেন। যার ফলে তিনি কখনই মাতুয়াইল শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে রোগীদের সময় দেন না। সেখানে তিনি হাজিরা দিয়ে কখনো সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যান। আবার কখনো থেকে দুই ঘণ্টা থেকে চলে যানে নিজের প্রতিষ্ঠানে।
অভিযোগ উঠেছে, মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে রোগী দেখে আর্থিকভাবে খুব একটা লাভবান হওয়া যায় না। এই কারণে তিনি সেখানে খুব একটা রোগী দেখেন না। বরং এখানে যেসব রোগী তারি কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন তাদেরকে নিজের প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন দালালদের মাধ্যমে।
মো. আবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, সরকারি ডাক্তার হয়ে তিনি বেশিরভাগ সময় প্রাইভেট ক্লিনিক এ সময় দেন। তাহলে এসব ডাক্তারদের সরকারি চাকরি নেওয়ার দরকার কী?
নজরুল ইসলাম, নিলুফা বেগম, জয়নাল মিয়া, ও আব্দুস সাত্তারসহ আরও অনেকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই অভিযোগ, সময়মত হসপিটালে না পেয়ে অনেক মানুষ ডা. মুজিবুর রহমানের পার্সোনাল মেডিকেলে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমাদের পার্সোনাল চিকিৎসা নেওয়ার মতো টাকা পয়সা নাই, এজন্য আমরা সরকারি হাসপাতালে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছি।
মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিউটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, একজন চিকিৎসক কীভাবে এতগুলো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকতে পারেন তা কোনোভাবেই মিলাতে পারি না।
তিনি বলেন, ডা. মজিবুর রহমান আমার সিনিয়র, তার বিষয়ে আসলে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে, এটা অবশ্যই রহস্যজনক, একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি কীভাবে এতগুলো প্রতিষ্ঠানের মালিক!
ওই চিকিৎসকের অভিযোগ, ডা. মুজিবুর রহমান মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে তেমন একটা সময় দেন না। সকাল দশটার সময় এসে কিছুক্ষণ পরই বের হয়ে পড়েন। যেখানে থাকার কথা বিকাল ৫টা পর্যন্ত। তিনি নিজের হাসপাতালেই বেশি সময় দেন। অনেক সময় দেখা গেছে, তিনি সরকারি হাসপাতাল থাকলেও তার লোকজন রোগীদের পাঠিয়ে দেন তার হাসপাতালের চেম্বারে। শুধু তাই নয়, তাদের কাছ থেকে তিনি অতিরিক্ত টাকাও নিচ্ছেন।
যা বললেন ডা. মুজিবুর
শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে সময় না দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে রোগী দেখছেন, চিকিৎসার নামে বেশি টাকা নিচ্ছেন-এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মুজিবুর রহমান বলেন, আমি হাসপাতালে যথেষ্ট সময় দিয়ে থাকি। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু দিয়ে আমার অন্যান্য জায়গায় সময় দিতে হয়। কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেয় তাহলে সেটা ভিত্তিহীন।
নিজের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি একজন চিকিৎসক মানুষকে সেবা দিয়ে থাকি। সরকারি হাসপাতালে রোগীদেরও পর্যাপ্ত সময় দিয়ে থাকি। আমার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ নেই। তবে আমি কারো মাথায় বাড়ি দিয়ে টাকা পয়সা রোজগার করছি না।
নিজের এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় ডায়নাগোস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়েছি এসব একদিনে হয়নি। এসবে অনিয়মের কিছু দেখছি না। এর সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত রয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে এই চিকিৎসক বলেন, আমারটা অনিয়মের মধ্যে পড়ে। যারা কোটি কোটি টাকা চুরি করে সেটা অনিয়মের মধ্যে পড়ে না? অন্য মানুষ যখন বাসার মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা রেখে দেয় তখন তো কেউ অনিয়ম বলে না ? ব্যাংক থেকে অনেকে ঋণ নিয়ে কয়েক কোটি টাকা মেরে দেয় সেটাকে অনিয়ম বলে না? আমি সামান্য কাজ করছি মানুষকে চিকিৎসা দিচ্ছি এখানেই অনিয়মটা মানুষের চোখে পড়ল।’
এনএইচবি/এমএমএ/