সাঈদের বড় শিল্পী হওয়ার সম্ভাবনাকে গিলে খেল মাদক!
বড় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। নিজে গান লিখতেন। গান গাইতেন। সেইসব গান নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করাসহ একাধিক ইউটিউব চ্যানেলে বিক্রিও করেন। কিন্তু গান তাকে ডাকেনি। সেখানে ভালো কিছু করতে পারেননি। বড় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন হোঁচট খায়। তারপরই পা বাড়ান অন্ধকার জগতের দিকে। প্রথমে মাদকসেবন করতেন। পরে হয়ে উঠেন মাদক উৎপাদনকারী। নিজেই মাদক তৈরি করে বিক্রি করতে শুরু করেন। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এখন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ভাষায় তিনি মাদক বিজ্ঞানী।
এই গল্পটা ওনাইসি সাঈদ ওরফে রেয়ার সাঈদের। ‘কুশ’ নামে একধরনের নতুন মাদকের আবিষ্কারক। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, ‘কুশ’ ভয়াবহ একটি মাদক। এটি ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, আইস সেবনের পরের ধাপ। যাদের সাধারণ মাদকে নেশা হয় না তারাই বিশেষ করে ‘কুশ’ সেবন করে থাকে। ‘কুশ’ মাদক হিসেবে অভিজাত। এটি সাধারণত ধনীরাই বেশি সেবন করে।
অনেক গবেষণার পর নতুন মাদক ‘কুশ’ তৈরি করে বিদেশে পাচারের পরিকল্পনা করেছিল সাঈদ। সম্প্রতি তাকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, সাঈদ হচ্ছেন দেশের প্রথম ‘মাদক বিজ্ঞান‘।
র্যাব বলছে, সাঈদ বিভিন্ন নতুন ধরনের মাদক সেবন করে এবং তা তৈরির আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করতেন।
ওনাইসি সাঈদ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায়। তার পিতার নাম এ এম এস সেলিম। তিনি একজন ব্যবসায়ী। গ্রামের বাড়ি নলছিটিতে হলেও তারা থাকেন ঢাকার মোহাম্মাদপুরে একটি ভাড়া বাসায়। তবে সাঈদ তার পরিবারের সঙ্গে থাকতেন না। আলাদা বাসায় থাকতেন। পরিবাারের সদস্যরাও তার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
সাঈদের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, দেশের একটি ইংলিশ মিডিয়াম কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন সাঈদ। সেখান থেকে বিবিএ-এমবিএ সম্পন্ন করেন। কিন্তু তার ঘটনা জানার পর তার পরিবার হতাশ তার বিষয়ে।
পরিবারের তথ্যানুযায়ী, ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতির দিকে ঝোঁক ছিল তার। সে এটা চর্চাও করত। কিন্তু মাদকের এত বড় বিষয়টি পরিবার মেনে নিতে পারে না। তবে বিদেশ থেকে আশার পর সে পরিবার থেকে দূরে ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাঈদ গানের অ্যালবাম বের করেছিলেন ২০১৭ সালের অক্টোবরে। ‘রাজত্ব' নামের ওই অ্যালবামে তার গাওয়া ১১টি গান ছিল। এসব গানের মধ্যে ছিল-নেশা নেশা আমারি, লিজা শুধু আমার, বিবর্ণ শ্রষ্ঠা অন্যতম। এ ছাড়া তার কয়েকটি গান রয়েছে- বাংলা মিউজিক ভিডিও নামে ইউটিউব চ্যানেলে।
জানা যায়, বিদেশে পড়ালেখা শেষ করে ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করেন সাঈদ। আগে থেকেই মাদক সেবন করতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় গিয়ে বিভিন্ন বার ও ক্লাবে যেতেন এবং সেসব জায়গা থেকে মাদকের স্যাম্পল সংগ্রহ করতেন। বিদেশে ফয়সাল নামের একজনের সঙ্গে সাঈদের পরিচয় হয়। পরে ফয়সালের সহযোগিতায় বিভিন্ন অপ্রচলিত মাদক দেশে এনে কারবার শুরু করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ৪ বছর ধরে এক্সট্যাসিসহ অন্য উচ্চমূল্যের মাদকের কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে যান সাঈদ। এ ছাড়া বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন তার সহযোগী হিসেবে কাজ করে। পার্সেলের মাধ্যমে সে বিভিন্ন দেশ থেকে এসব মাদক সংগ্রহ করে মাঝে-মধ্যে নিজেও বিদেশ যেতেন। ফেরার সময় লাগেজে করে অপ্রচলিত সব মাদক আনতেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (মনোবিজ্ঞানী) শিরিন সুলতানা বলেন, মাদক তৈরি করার পরিকল্পনা দীর্ঘদিন ধরে কেউ যদি চেষ্টা করে তাহলে এটা সম্ভব হতে পারে। তবে এ সব মানুষ বেশিরভাগ সময় একা থাকে। নিজে নতুন নতুন মাদক সেবনের পর মাদক তৈরির চিন্তা করে। এরা সাধারণত অস্বাভাবিক আচরণ করে। সাঈদের ক্ষেত্রে হয়তো এমনটাই হয়েছে।
তিনি বলেন, অনেকেই জীবনের টার্গেট পূরণ করতে না পেরে ভিন্ন পথে চলে যায়, তার ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন হয়েছে।
তিনি বলেন, তা ছাড়া অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যায়। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। এতে তার আচার-আচরণেরও বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। হয়তো সাম্প্রতি গ্রেপ্তারকৃত মাদক উৎপাদক সাঈদের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। তিনি বলেন, এর জন্য তার পরিবারও অনেকটা দায়ী। পরিবার যদি ঠিক মতো তার খোঁজ-খবর নিত তাহলে এমন ঘটনা ঘটার আগে পরিবার জানত। বিষয়টিও সমাধান হতো। এজন্য বিশেষ করে পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতে হবে। একেবারে তাদের ছেড়ে দিলে হবে না।
এনএইচবি/টিটি