চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘বিলাসী’ প্রকল্প
চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি’ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়। এ কারণে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি ৫ বছরেও। বরং সময় ও ব্যয় দুটোই বেড়েছে। এটি হয়ে উঠছে বিলাসি প্রকল্প।
বৈশ্বিক সংকটের কারণে কৃচ্ছ্রসাধনের এই সময়ে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে ‘খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের খাতওয়ারি খরচ বাড়ছে।
প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ সাড়ে ছয় হাজার কাঠা থেকে কমিয়ে ২ হাজার ৭০৩ কাঠায় নিয়ে আসলেও এই খরচ বাড়ানো হয়েছে ২ হাজার ২৪২ টাকা। পরামর্শক ফি ১১০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১৮৫ কোটি টাকা। গ্যাস, জ্বালানি খাতে ব্যয় এক কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, সম্মানি ৩০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা।
মূল প্রকল্পে না থাকলেও এক কোটি টাকার বেশি দামে জিপ গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের খরচ বাড়ছে ৭০ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হচ্ছে ৭১ শতাংশ।
সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের জন্য সরকার ২০১৭ সালে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, বাড়ি ভাড়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ বিভিন্ন খাতে খরচ বাবদ অনুমোদন দিয়েছিল পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এখন এই প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে নয় হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। এক লাফে খরচ বাড়ছে তিন হাজার ৯১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ খরচ বাড়ার হার ৭০ শতাংশ। খরচের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রকল্পের কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গলদ রেখেই উল্টোপথে হেঁটেছে প্রকল্পের কাজ। কারণ, এই প্রকেল্পের সম্ভাব্যতা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) যাচাইয়ের আগে প্রণয়ন করা হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)। যা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো। যার ফলে এখন এসে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ছে প্রকল্পে। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে এই প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডিপিপি দুই দফা সংশোধন করে দুই বছর সময় বাড়ানো হয়। প্রথমে এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন এবং পরে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত আরও এক বছর বাড়ানো হয়। কিন্তু তাতেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। জলাবদ্ধতা থেকেও মুক্তি মিলেনি চট্টগ্রাম নগরবাসীর। এই অবস্থায় এবার প্রকল্পের সময় বাড়ানো হচ্ছে আরও দেড় বছর।
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মো. শাহ আলী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭১ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। বিভিন্ন ত্রুটির কারণে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রয়োজন, তা করা হচ্ছে। কারণ, আগে ডিপিপি করা হয়েছিল। পরে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছিল। এতে ভূমি অধিগ্রহণ কমছে। এটা সিডিএ করছে। আগে দুই জন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ছিলেন। আমি তৃতীয় পিডি। দায়িত্ব নিয়ে সাধ্য মতো কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।
প্রকল্প সংশোধনের ব্যাপারে এক প্রশ্নের উত্তরে এই পিডি বলেন, ‘বলা যায় প্রকল্পটি আগে হ্যাঁ উল্টোপথে হেঁটেছে। ডিপিপি করার পর ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে। এ জন্য ড্রয়িং ও ডিজাইন পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে হচ্ছে।’
নকশায় ত্রুটি
জানা গেছে, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা বিস্তারিত সার্ভে ও সমীক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে। তার ভিত্তিতে নকশা ড্রয়িংও করে।
কিন্তু তার আগেই চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা দূর করতে এই প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করে তাতে অনুমোদন দেয় সরকার।
জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নের গড়িমসির কারণ জানতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ এর সঙ্গে সোমবার (১ আগস্ট) যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলব ।’ পরে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি আর সাড়া দেননি।
একটু পানিতেই ডুবছে চট্টগ্রাম
একটু বর্ষাতেই তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার বহু রাস্তাঘাট ও আবাসিক এলাকা। তৈরি হয় জলাবদ্ধতার। ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা আবু তৈয়ব ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘কাজের অগ্রগতি ৭১ শতাংশ হলেও চট্টগ্রাম শহরে ভোগান্তি কমেনি। বরং আগের চেয়ে বেশি তলিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে আগে ৩ ফুট ডুবে থাকলেও বর্তমানে ৫ ফুট ডুবে যাচ্ছে। বড় ধরনের ত্রুটি রেখেই এসব উন্নয়ন করা হচ্ছে। এ জন্য অল্প বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহর তলিয়ে যায়।
উন্নয়নের পর ভোগান্তি পিছু ছাড়ছে না উল্লেখ করে শহরের বহাদ্দার হাটের ইদ্রিস শওদাগর জানান, এমন উন্নয়ন হচ্ছে যে খোদ মেয়রের বাড়ি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘন্টা ডুবে ছিল। এত টাকা খরচ করে তাহলে লাভ কী হলো?
পরামর্শকের পিছনে ১৮৫ কোটি টাকা
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া প্রকল্পের কাজ অর্ধেকের বেশি শেষ হয়েছে। তারপরও ডিপিপিতে বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তাতে খরচ ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এই খরচের যৌক্তিকতা নিরুপনে ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
তাতে ব্যয় কমিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে নয় হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। এতে ভূমি অধিগ্রহণ ৬ হাজার ৫১৬ কাঠা থেকে কমিয়ে ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭৬৪ কাঠা। টাকার পরিমাণ এক হাজার ৭২৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২৪২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ তিন হাজার ৮১২ কাঠা কমলেও খরচ বাড়ানো হচ্ছে ৫১৪ কোটি টাকা। এই কাজটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সরাসরি তদারকি করছে।
ড্রেনের সংরক্ষণ ও পরিস্কার করতে ৪০ কোটি টাকা থেকে ৮০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। পরামর্শক খাতে খরচ বাড়িয়ে ১৮৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ কমাতে বললেও প্রশিক্ষণ ভাতা এক টাকাও কমানো হয়নি। বরং প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সেটি বাড়িয়ে দুই কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
এই প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে ৩৬ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ; ১৯ লাখ ৫৯ হাজার ঘনমিটার খালের কাদা অপসারণ; ২১ লাখ ৭৭ হাজার ঘনমিটার মাটি খনন; এক লাখ ৬৩ হাজার মিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ; ১১৫টি আরসিসি কালভার্ট নির্মাণ; তিনটি বন্যার পানি সংরক্ষণ জলাধার নির্মাণ; ৫০ কিলোমিটার খালের পাড়ে পায়ে হাঁটার রাস্তা (ফুটপাত); ১২টি যানবহন ক্রয় ও প্রায় ১৫ লাখ ঘনমিটার ড্রেনেজ সংরক্ষণ ও পরিষ্কার। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু কাজ রয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এই খরচ যাচাই-বাচাই করতে পরিকল্পনা কমিশনে ২৯ জুন প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। আগামীকাল ৩ আগস্ট পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হবে।
নির্দেশনার বাইরে কিছু থাকলে বাদ
অবশ্য পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেছেন, ‘সরকারের নির্দেশনার বাইরে বেশি কিছু ধরা হলে সেই আইটেম কেটে দেব।’ চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সংশোধনীতে নতুন করে গাড়ি কেনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের সর্বশেষ নির্দেশনার আলোকে প্রকল্প সংশোধন করা হবে। কালও (সোমবার) এ ব্যাপারে আমার সচিবকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একনেক সভায় পাস হলেও নির্দেশনার বাইরে কিছু থাকলে তা কেটে দিব।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন,পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকে বলা হয়েছে, এর আগে দুই বার খরচ ছাড়া সংশোধন করা হয়েছে। এবার যেহেতু খরচও বাড়ছে। তাই মেয়াদও বাড়ানো যেতে পারে। এতে আইএমইডির কোনো সুপারিশ প্রয়োজন নেই।
চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় রবিবার (৩১ জুলাই) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, প্রকল্প গ্রহণের নামে সরকারি অর্থের অপচয় করা যাবে না। জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের বড় একটি সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী নিজে সময়ে সময়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তারপরও জলাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে।
এনএইচবি/এমএমএ/