বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড ঋণ ও অনুদান পেয়েছে বাংলাদেশ
বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগিদের কাছ থেকে আগের বছরের চেয়ে ২০৫ কোটি ডলারেরও বেশি ঋণ নিয়েছে। করোনার ধকল সামলাতে ও উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে বাজেট সাপোর্টের জন্য সরকার এই ঋণ নিয়েছিল। যা এক বছরের ব্যবধানে ২৫ শতাংশের বেশি। একই সঙ্গে সরকার ঋণ পরিশোধও করেছে সাত শতাংশের বেশি। আর উন্নয়ন সহযোগিদের প্রতিশ্রুতির পরিমান কমেছে ১৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবেলা করতে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সংস্থা অল্প সময়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে তেমনটা হবে না। অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ইআরডির প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে (২০২১-২২) বিভিন্ন বিদেশি উন্নয়ন সহযোগিরা বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিয়েছে এক হাজার কোটি ডলারের বেশি। এরমধ্যে অনুদান (যা পরিশোধ করতে হবে না) ১৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার এবং ঋণ হচ্ছে ৯৮১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে তারা ঋণ ও অনুদান দিয়েছিলো ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এরমধ্যে অনুদান ৫০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার ও ঋণ ৭৪৪ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ ঋণ বেশি পেয়েছে ২০৫ কোটি ডলারের বেশি বা ২৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে এডিবি ২৬৫ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। এরপর জাইকা ২২০ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিশ্বব্যাংকের আওতায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা(আইডিএ) ১৬৬ কোটি ৭৫ লাখ। এরপর এআইআইবি দিয়েছে ২৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এছাড়া রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাও বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে ভারত ও রাশিয়া কোনো ধরণের প্রতিশ্রুতি না দিলেও দেশ দুটি বাংলাদেশকে ৩২ কোটি ৪১ লাখ ও ১২২ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ঋণ দিয়েছে। আর এআইআইবি নতুন হলেও বাজেট সাপোর্ট, কোভিট সাপোর্টসহ অন্যান্য ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ দিয়েছে ২৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে জাপান (জাইকা), চীন, বিশ্বব্যাংক, রাশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এ পর্যন্ত ঋণ ও অনুদান দিয়েছে ১১ হাজার ১৩৭ কোটি ডলার।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে (২০২১-২২) ঋণ পরিশোধ করেছে ২০১ কোটি ৪১ লাখ ডলার। এরমধ্যে আসল ১৫২ কোটি ৪৯ লাখ ডলার ও সুদ ৪৮ কোটি ৯২ লাখ ডলার। যা আগের বছরে পরিশোধ করা হয়েছিলো ১৯১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এরমধ্যে আসল ১৪১ কোটি ৮৬ লাখ ডলার ও সুদ ৪৯ কোটি ৬১ লাখ ডলার।
এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ ১১৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বা সাত শতাংশের বেশি ঋণ পরিশোধ করেছে।
ইআরডি আরও জানায়, বিদায়ী অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগিরা বাংলাদেশকে ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এরমধ্যে অনুদান ৩৭ কোটি ৭৮ লাখ ডলার ও ঋণ ৭৮২ কোটি ৭১ লাখ ডলার। তারা আগের অর্থবছরে ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো ৯৪৪ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এরমধ্যে অনুদান ৭০ কোটি ও ঋণ ৮৭৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগিরা ঋণ ও অনুদানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার চেয়ে ১২৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার বা ১৫ শতাংশ কম দিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৯৪৪ কোটি ৩৮ লাখ ডলার সহযোগিতা ও ঋণ দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগিরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদায়ী অর্থবছর করোনাকালিন হওয়ায় অনেকে দ্রুত ঋণের ব্যবস্থা করেছে। কেউ বা অনুদানও দিয়েছে দ্রুত। সুনাম ধরে রাখতে তাই বাংলাদেশও তাদের ঋণ পরিশোধ ভালোভাবে করেছে। এটা ভালো দিক। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে সামনে বাংলাদেশকেও কঠির অবস্থা মোকাবেলা করতে হতে পারে। তাই সামনের দিনগুলোতে বড় বড় ঋণের দায় বেশি করে পরিশোধ করতে হবে। তখন হয়ত একটু সমস্যা হবে।
বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন,‘ কোভিডের কারণেই বিদায়ী অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের জন্য বেশি করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা ঋণ দিয়েছে। কেউ বা অনুদানও দিয়েছে। এ জন্য ঋণ বিতরণ (ডিসবার্সমেন্ট) বেড়েছে। তবে সম্প্রতি সময়ে কোভিডের তেমন প্রভাব নেই। তাই চলতি অর্থবছরে ঋণ কমবে। তবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বেশি হলে তা বাড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন,‘ বাংলাদেশ ঋণ বেশি করে পরিশোধ করেছে। এটা ভালো দিক। কিন্তু বিশ্বমন্দা যেভাবে চলছে তার ধাক্কা বাংলাদেশেও লাগতে পারে। অপরদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-১, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৫, লাইন-৬, মাতাবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রজেক্ট, পদ্মা ব্রিজ রেল সংযোগ, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে ব্রিজ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আবার ঋণ যেহেতু বাড়ছে তা পরিশোধের পরিমানও বাড়াতে হবে।’
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের ২০টি মেগা প্রকল্পের বৈদেশিক অর্থায়ন সাশ্রয়ীভাবে হয়েছে, এটা বড় সন্তোষের জায়গা। তবে এসব মেগা প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসবে ২০২৪ ও ২০২৬ সালে। এসব প্রকল্পে ৪৫টি ঋণ প্যাকেজের মধ্যে ৫টি অনুদান, ৩৩টি সাশ্রয়ী ঋণ প্যাকেজ, আধা-সাশ্রয়ী ২টি ও বাণিজ্যিকভাবে নিতে হয়েছে ৫টি ঋণ প্যাকেজ। যা চীন থেকে এসেছে। বৈদেশিক এই দায়-দেনা ১৭ শতাংশের নিচে রয়েছে।
এনএইচবি/এএস