বিশেষ প্রতিবেদন
বিদেশে সফল ঘরে অবহেলিত ওয়ানডে ক্রিকেট
টেস্ট ক্রিকেটের বনেধি পরিবারের সদস্য হতে হলে লঙ্গার ভার্সন ম্যাচকে অগ্রাধিকার দেয় হয়। যদিও টেস্ট পরিবারের সদস্য হওয়ার আগে চার দিনের প্রথম শ্রেণির ম্যাচে শুরু করেছিল বিসিবি। কিন্তু সে সময় ঘরোয়া ক্রিকেটের মূল আকষর্ণই ছিল প্রিমিয়ার বিভাগ ক্রিকেট লিগ। শুধু এই আসরই নয়, প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের ক্লাবগুলোকে নিয়ে দামাল-সামার ক্রিকেট, শহীদ স্মৃতি ক্রিকেট আসরও বসতো। মৌসুম শুরু হতো দামাল-সামার স্মৃতি আসর দিয়ে। শেষ হতো শহীদ স্মৃতি আসর দিয়ে। সবই এখন স্মৃতির পাতায় ঠাই নিয়েছে। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে পথ চলা শুরু করার পর সেই ওয়ানডে আসরগুলোই অপাংক্তেয় হয়ে গেছে! যে প্রাণের স্পন্দন ছিল প্রিমিয়ার বিভাগ ক্রিকেট লিগ, তা হারিয়েছে গুরুত্ব। শীতের ক্রিকেট গিয়ে জায়গা পেয়েছে ভরা বর্ষায়! বৃষ্টির কারণে অনেক ম্যাচই ভেস্তে যায়। আবার লিগ শুরু হলেও জাতীয় দলের খেলা থাকলে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা থাকেন অনুপস্থিত । সব মিলিয়ে বলা যায় ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়ানডে আসর যেন সৎসন্তান! যে সবেধন নিলমনি প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ তা বিসিবি শুধু আয়োজনই করে থাকে। ক্লাবগুলো নিজেদের টাকা খরচ করে বিশাল বাজেটে এক একটি দল গঠন করে। বিসিবি থেকে তারা যে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকে, তা এক এক মৌসুমের মোট খরচের ১০ ওভাগের এক ভাগও হয় না ! অথচ আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য বেশি এই ওয়ানডে ক্রিকেটেই। আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে যাত্রাও শুরু সবার আগে সেই ১৯৮৬ সালে।
তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে বিসিবি বেশ গুরুত্ব দিয়েই ঘরোয়া আসর আয়োজন করে থাকে বিপিএল । মৌসুমের সেরা সময়টা বেছে নেয়া হয় বিপিএলের জন্য। শীতের সময় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে অত্যন্ত জাকজমকভাবেই এই আসর আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ সময় জাতীয় দলেরও কোন খেলা থাকে না। কিন্তু আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ এই ফরম্যাটেই সবচেয় বেশি ব্যর্থ। মাত্রই শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ব্যর্থতার ক্ষত এখনও কোটি কোটি দেশবাসীর অন্তর পুড়ছে। ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই আসরের সব কটিতেই অংশ নিয়ে জয় পেয়েছে মাত্র একটিতে। তাও সেই শুরুর আসরে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬ উইকেটে। দ্বি-পাক্ষিক সিরিজেও নেই আশাব্যঞ্জক ফলাফল। টুর্নামেন্ট ও দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ মিলিয়ে হারের তালিকায় নাম আছে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, এমনকি নেদারল্যান্ডস, হংকংয়ের মতো দলের কাছেও। এখন পর্যন্ত ১২৩টি ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছে ৪৩টি। যার সিংহভাগ জয় এসেছে অপেক্ষাকৃত দূর্বল নেপাল, কেনিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত,নেদারল্যান্ডস, পাপুয়া নিউগিনি, জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। টেস্ট পরিবারের নবীন সদস্য আফগানিস্তানের কাছেও বাংলাদেশের হারের পাল্লা বেশি। জয় পায়নি ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এমনকি স্কটল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষেও। স্কটল্যান্ডে কাছে দুই ম্যাচ খেলে দুইটিতেই হার মেনেছে। অস্ট্রেলিয়ার আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একাধিক জয় থাকলেও তা এসেছে এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাঠে হোম কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে স্লো উইকেট বানিয়ে!
টেস্ট ক্রিকেটের অবস্থা আরো নাজুক। ১২৫ টেস্ট খেলে জয় আছে মাত্র ১৫টিতে। যার অর্ধেকেরও বেশি জয় আবার খর্ব শক্তিতে পরিণত হওয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮টি। ৪টি জয় আছে আরেক খর্ব শক্তি দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। বাকি তিন জয় এসেছে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-শ্রীল্কার বিপক্ষে। প্রথম দুই দেশের বিপক্ষে জয় এসেছিল ঘরের মাঠে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়টি ছিল বেশ স্মরণীয়।শ্রীলঙ্কার মাটিতে বাংলাদেশের শততম টেস্টে। অথচ এই টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ যাতে ভালো করতে পারে সে জন্য এনসিএলের পর বিসিএলও শুরু করা হয়। কিন্তু এনসিএল পরিণত হয়েছে ‘পিকনিক’ আসরে। এখানে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের খেলতে দেখা যায় কালে-ভাদ্রে। জাতীয় দলের খেলা না থাকলেও তারা এই আসর খেলতে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন। বিসিবির পক্ষ থেকেও সেভাবে কোন দৃঢ় পদক্ষেপ নেয় হয় না। বিসিএল ফ্রাঞ্চাইজি আসর হওয়াতে এখানে অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে মোটামুটি। কিন্ত চার দলের আসরে ম্যাচের সংখ্যা থাকে খুবই কম!
ওয়ানডে আসর আয়োজনের ক্ষেত্রে বিসিবি কম গুরুত্ব দিলেও তারপর সেখানেই হয়ে থাকে জমজমাট লড়াই। একটা সময় আবাহনী-মোহামেডান-বিমানের লড়াই ছিল, এখন সেখানে আবাহনী- প্রাইম ব্যাংক-প্রাইম দোলেশ্বর-লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ, গাজী ট্যাংক ক্রিকের্টাস,ওল্ড ডিওএইচএস, গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স শামিল হয় শিরোপার লড়াইয়ে। মাঠের লড়াইয়ে থাকে টানটান উত্তেজনা। উত্তেজনার পারদ ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেটারদের মাঝেও। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সাকিব-তামিমের মতো ক্রিকেটারদের এক থেকে একাধিক ম্যাচ পর্যন্ত সাজাও পেতে হয়েছে। তারপরও এই আসরের প্রতি বিসিবি এতোই উদাসীন যে শীতের ক্রিকেট বর্ষায় নিয়ে যাওয়ার পরও এবার সেই আসর হয়েছে ২০ ওভারে। যদিও বিসিবির তরফ থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে করোনার কারণে।
আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ওয়ান ডে ম্যাচ খেলেছে ৩৮৮টি। ১৩৬ জয়ের মাঝে জয় আছে টেস্ট খেলুড়ে সবগুলো দেশের বিপক্ষে। সবচেয়ে বেশি জয় আছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫০টি। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৮টি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০টি। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডে, হংকংয়ে মতো দলের কাছে হারলেও ওয়ানডেতে কখনোই হারেনি। টি-টোয়েন্টতে আফগানিস্তানের সাথে পেরে না উঠলেও ওয়ানেডেতে ঠিকই নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়ে।
আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের যতো মনমুগ্ধকর জয়, তা এই ওয়ানডে ম্যাচকে ঘিরেই। ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলতে গিয়েই পাকিস্তানকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করেছিল। ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনে পাওয়া জয়ে রাতের আঁধারে দেশবাসী নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। তা ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ২০০৫ সালে কার্ডিফেও অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর সৃষ্টি হয়েছিল আনন্দঘন পরিবেশ। ঠিক সে রকম না হলেও ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ভারত আর সুপার সিক্সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাওয়া জয়েও দেশবাসীকে আনন্দ করার উপলক্ষে এনে দিয়েছিল। এমনি করে আরও অনেক উপলক্ষ আছে ওয়ানডে ক্রিকেটকে ঘিরেই। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ যে ছয়টি ফাইনাল আসর খেলেছে তার চারটিই ছিল একদিনের আসরে। একমাত্র শিরোপাও এসেছে এই আসর থেকে। আবার আইসিসিরি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ২০১৭ সালের আসরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালও খেলেছিল। ২০১৫ সালের অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খেলেছিল কোয়ার্টার ফাইনাল। তাই অনেকেরই অভিমত এখানে যদি বিসিবি আরও বেশি গুরুত্ব দিতো, তা’হলে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের এখানে সাফল্য আরও বেশি হতে পারতো।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো এখনো দূর্বল। ওয়ানডে ক্রিকেটও এর বাইরে নয়। প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ যে হচ্ছে, সেটাতো ক্লাবগুলোর অবদান। বিসিবি শুধু আয়োজন করে থাকে। তারপর সেখানে এক একবার এক এক নিয়ম করা হয়। আগের মতো গুরুত্বও হারিয়েছে। টি-টোয়েন্টি ও টেস্টের তুলনায় ওয়ান ডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য বেশি হলেও সেটাকে খুব বড় করে দেখার উপায় নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে নজর দেয়া হলে ওয়ানডে ক্রিকেটও গুরুত্ব পাবে। তারপরও একমাত্র প্রিমিয়ার বিভাগ লিগ খেলে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ যতোটুকু সাফল্য পেয়েছে,সে কথা বিবেচনা করে বিসিবির উচিত হবে ঘরোয়া ক্রিকেটে এখানে আরও বেশি নজর দেয়া।’
জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিম গুল্লু বলেন, ‘ওয়ানডে ক্রিকেটে যে সাফল্য তা কিন্তু মাশরাফি-সাকিব-মুশফিক-তামিম-মাহমুদউল্লাহসহ আরও কয়েকজন ক্রিকেটারের কারণে। এরা কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেট খেলেই উঠে এসেছেন। তাদের কনসেপটে কিংবা শক্তি তাই ওয়ানডে ক্রিকেটেই বেশি। তাই এখানে অন্য দুই ফরম্যাটের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য বেশি। শুধু ক্লাব ক্রিকেটেই নয়, জেলা পর্যায় থেকে যারা উঠে আসছেন তারাও কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেট খেলেই। অন্য দুই ফরম্যাটের তুলনায় ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য বিবেচনা করে বিসিবির ঘরোয়া ক্রিকেটের ওয়ানডে টুর্নামেন্টের দিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত।
বিসিবির পরিচালক ও মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস এটিকে বিসিবির মোটেই উদাসীনসা বলে মনে করেন না। মূলত জাতীয় দলের ব্যস্ততার কারণেই আলাদা করে আর কোনো টুর্নামেন্ট আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান। তিনি বলেন,‘ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে আমাদের আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলা হতো খুবই কম। যে কারণে প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ ছাড়াও আরো একাধিক টুর্ণামেন্ট হতো। এখন ইচ্ছে থাকলেও আয়োজন করা সম্ভব হয় না। এটা আমাদের উদাসীনতা নয়, বাস্তবতা। যেমন এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ শেষ হওয়ার পরদিনই দল চলে যাবে নিউজিল্যান্ড। আগামী বছর থাকবে টানা খেলার মাঝে। ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ে কিন্তু ওয়ানডে খেলাই হয়। সেখানে আমাদের নজরদারী থাকে।’
এমপি// জেডএকে