যেভাবে নির্মিত হল পদ্মা সেতু

দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলার প্রায় চার কোটি মানুষের স্বপ্ন প্রমত্তা পদ্মার বুকে প্রথম ডানা মেলেছিল ১৯৯৮ সালে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে দেশের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে একীভূত করতে ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার অবহেলিত জনপদের মানুষের স্বপ্নের বীজ বুনে পদ্মায়।
ওই বছর দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টায় পদ্মা নদীতে সেতুর বীজ বপন হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। বলা যায়, এটাই দালিলিকভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম সূত্রপাত। এ হিসাবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের যাত্রা শুরু হয় প্রায় দুই যুগ আগে।
রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কে পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য ১৯৯৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তিন হাজার ৬৪৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার চওড়া এই সেতুটিকে দেশের সম্ভাব্য দীর্ঘতম সেতু হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল তখন। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে নির্মাণ কাজ শুরু করার এবং ২০০৪ সালের জুনে শেষ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবিত অর্থের মধ্যে দুই হাজার ৬৯৩ কোটি ৫০ টাকা বিদেশি উৎস থেকে এবং সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৭৫০ কোটি টাকা জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচনে পরাজিত হলে পদ্মা সেতু নির্মাণের সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে।
যদিও ২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার জাপানের আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ২০০৩ সালের মে থেকে নতুন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কাজ শুরু করে। ওই সময়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় মূলত পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে। সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শেষ হয়েছিল ২০০৫ সালে। পরের বছর ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার সময় জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোই সেতুর একটি প্রাথমিক নকশা তৈরি করে। তবে তারা জানিয়ে দেয় যে সেতু নির্মাণের আগে পূর্ণাঙ্গ নকশা প্রণয়ন করতে হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই উদ্যোগও আর আগায়নি। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রতি দেওয়া হয়েছিল নির্বাচিত হলে পদ্মায় সেতু নির্মাণ করা হবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকার শুরুতেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে হাত দেয়।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে সেতু প্রকল্পে রেল চলাচলের সুবিধা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেল সুবিধা যুক্ত করে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের নির্দেশনা দেন। এর মধ্যেই সরকার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়।
২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হয়ে যায়। পরের বছর জানুয়ারিতে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে প্রথমবারের মতো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
শুরুতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। পরে তা বৃদ্ধি করে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করা হয়। প্রথম ডিপিপিতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে তিনটির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রেখে নকশা করা হয়েছিল। পরে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখার বিষয়টি যুক্ত করা হয়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির কথিত অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তুতির শুরুতেই কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর মত বৃহৎ প্রকল্প থেকে সড়ে দাঁড়ায় মূল ঋণদাতা বিশ্বব্যাংক। তার চুক্তি থেকে সড়ে যায়। এরপর অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগি ঋণ প্রদান থেকে সড়ে যায়।
বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগিদের পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সড়ে দাঁড়ানোর পর এই প্রকল্প নিয়ে অনেকটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এরমধ্যেই এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসে মালয়েশিয়ার সরকার। এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলার পর তা আর এগোয়নি।
২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় সরকার। এরমধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান এবং আত্মবিশ্বাসে পদ্মা সেতু নির্মাণে সব দূর হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন কোন রকম বিদেশী বা উন্নয়ন সহযোগিদের কাছ থেকে ঋণ না নিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সেই দৃঢ় মনোবল, আত্মবিশ্বাস আর জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি যোগফল হচ্ছে আজকের পদ্মা সেতু। এতোদিন যেটি স্বপ্ন ছিল, সেটি এখন বাস্তব। আজ (২৫জুন) থেকেই এই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হবে।
পদ্মা সেতুর প্রকল্পের মূল সেতু নির্মাণের জন্য চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে নিযুক্ত করা হয়। পদ্মা দুই তীরে নদী শাসনের কাজ পায় আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তি দেওয়া হয়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর অনিশ্চয়তাকে দুমড়ে-মুচড়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর ৬ নম্বর পিলারের পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান।
অবশ্য ২০১৪ সালে তদন্ত শেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়ে দেয়, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে কানাডার টরন্টোর এক আদালত জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ পাননি তারা। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মত প্রমত্তা পদ্মার বুক জুড়ে এখন দৃষ্টিনন্দন ‘পদ্মা সেতু’ দেশের সক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৪২ টি পিলারের উপর ৪১টি স্প্যানে । যে সেতু দেশের ২১ টি জেলার সকল বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির গতি বদলে যাওয়ার জানান দিচ্ছে।
এসএম/এনএইচবি/
