অহংকারের পদ্মা সেতু
দেশের সড়ক পথে যোগাযোগের এক বিস্ময়ের নাম পদ্মা সেতু। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার ফসল। স্বপ্নের ফসল। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের একটি অনন্য উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার অঙ্গীকার। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে উদ্বোধন হলে বাংলার অহংকারের পদ্মা সেতু।
প্রকৃতপক্ষে পদ্মা সেতুর নির্মাণ যজ্ঞের ইতিহাস প্রায় দুইযুগের। ১৯৯৮-৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাই করে। পরে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে থেমে থাকে পদ্মা সেতুর নির্মাণ পরিকল্পনা। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে সেতু প্রকল্পে রেল চলাচলের সুবিধা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেল সুবিধা যুক্ত করে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের নির্দেশনা দেন। এর মধ্যেই সরকার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের চুক্তিও স্বাক্ষর করে সংস্থাটি। জাপান সরকারের দাতা সংস্থা জাইকা ৪০ কোটি, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬৪ কোটি এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে বলেও চুক্তি স্বাক্ষর করে।
ক্যানাডার এসএনসি লাভালিন কোম্পানি পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পায়। কিন্তু ক্যানাডার আদালতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ উঠলে দাতা সংস্থাগুলো প্রকল্প অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়।
অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়া ছিলো একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। পদ্মা সেতু যাতে না হয় এজন্য একটি মহল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আঙুল উঠে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ উউনুসের দিকেও। যদিও পরবর্তীতে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন।
সেতুর কাজ নিয়ে দূর্নীতির অভিযোগ উঠার পর সরকারের সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। প্রায় পাঁচ বছর তদন্তের পর দুর্নীতির অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি ক্যানাডার আদালত৷ এ অভিযোগকে আদালত ‘অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজব’ বলে আখ্যায়িত করে।
বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা প্রকল্প থেকে সরে গেলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি হবে এমন ঘোষণা দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দীর্ঘ প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবশেষে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ কাজের দায়িত্ব পায় চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিংকন্সট্রাকশন কোম্পানি। ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয় কাজ।
প্রথম দফায় ডিসেম্বর ২০১৫ সালে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। নদীশাসন, নকশায় পরিবর্তন আনাসহ নানা কারণে আবারো প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এবার ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা হয়।
এদিকে করোনার কারণে কাজের ধীরগতিতে আবারো পিছিয়ে যায় সেতুর কাজ।
এক যুগেরও বেশি সময় আগে ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে একনেক-এ পাশ হয় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প, যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার একশ’ ৬২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ত্রিশ হাজার একশ’ ৯৩ কোটি টাকা। এক যুগে ব্যয় বাড়ে তিনশ’ ভাগ। সর্বশেষ হিসেবে সেতুর নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে ত্রিশ হাজার একশ’ ৯৩ কোটি টাকা।
ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ হলো নকশায় পরিবর্তন আনা, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকল্পের শুরুতেই ত্রুটি ধরা পড়ে নকশায়। তাছাড়া নানা সময়ে নতুন পরিকল্পনাও যুক্ত করা হয়েছে। নদীশাসনে ধীরগতিও ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
গত বছর ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যানটি বসানো হয়। আর দৃশ্যমান হয় ছয় হাজার একশ মিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতুটি৷ ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যানটি বসানোর পর এর শেষ স্প্যানটি বসানো পর্যন্ত সময় লেগেছে তিন বছর। গত ৪ জুন পদ্মা সেতুতে প্রথম বাতি জ্বলে। আর ২২জুন আলোকিত হয় পুরো সেতু।
আজ ২৫ জুন ২০২২। স্বপ্নের পদ্মা সেতু ধরা দিল বাস্তবে।