সাক্ষাৎকার
পদ্মা সেতু অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে
মানুষের দাঁড়ানোর যেমন মেরুদণ্ড দরকার, পদ্মা সেতু তেমন। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক প্রকাশ হচ্ছে ‘পদ্মা সেতু’। এটি বাংলাদেশের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতে করবে। মেরুদণ্ড আগেই ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক ভিত যেটা সেটাই দেশের মেরুদণ্ড, সেই মেরুদণ্ডকে আরও বহুলাংশে শক্তিশালী করেছে পদ্মা সেতু।
স্বপ্নের এই সেতু নিয়ে ঠিক এভাবেই নিজের মনের কথাগুলো অবলীলায় বলেছেন পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এসএম শাহজাদা। একইসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু কীভাবে পুরো দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং জীবনযাত্রার মান বদলে দেবে। সেতু চালু হলে জাতীয় অর্থনীতিকে কীভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। পণ্য পরিবহন খরচ কমবে কমপক্ষে চারগুণ। বরাবর অবহেলিত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন কীভাবে ঘটবে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ১৮ জুন এসএম শাহজাদা ঢাকাপ্রকাশ-এর স্টুডিওতে এসে ঢাকাপ্রকাশের বিশেষ আয়োজন ‘পদ্মা সেতুর সম্ভবনা নিয়ে জননেতার মুখে জনতার কথা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন সিনিয়র রিপোর্টার শাহজাহান মোল্লা’র সঙ্গে। নিচে তার কথাগুলো তুলে ধরা হলো।
এই আইন প্রণেতা বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য সহজেই ঢাকায় ঢুকবে। কমবে পণ্য পরিবহন খরচ। পুরো অর্থনৈতিক অবস্থার আমুল পরিবর্তন ঘটবে।
ঢাকাপ্রকাশ: পদ্মা সেতু নিয়ে যদি কিছু বলেন…
এসএম শাহজাদা: পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে। বলে শেষ করা যাবে না। পদ্মার বুকে সেতু হবে, মুহূর্তেই ঢাকা থেকে পটুয়াখালী আবার দেশের অন্য কোথাও ছুটে যাওয়া যাবে সেতুর উপর দিয়ে। এমন স্বপ্ন সব সময় দেখতাম। এই সেতু শুধু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের না, সারা বাংলাদেশ এটার সুবিধাভোগী। আমাদের প্রতিবেশি দেশও এটা থেকে অনেক সুবিধা পাবে। বিশেষ করে যারা পোর্টভিত্তিক ব্যবসা করেন। আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নৌপথে লঞ্চে ঢাকায় আসতাম। সেজন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। অনেক তাজাপ্রাণ ঝড়ে গেছে নদী পথের দীর্ঘ বিড়ম্বনার কারণে। এসব দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা সবকিছুর অবসান হতে চলছে। ২৫ জুনেই নতুন উচ্চতায় যাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। যখন তখন ঢাকা থেকে যেতে এবং বাড়ি থেকে ঢাকায় আসতে পারব।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনি কি কখনো নদী পথে আসতে কোনো বিপদ বা সংকটে পড়েছেন?
এসএম শাহজাদা: প্রচুর, প্রচুর। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যেকটা মানুষ যারা রাজধানীতে বা অন্যান্য জায়গায় আছে তাদের সবারই এই অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতা অনেক সময় অনেক মর্মান্তিক। আমাদের ওখানে একটা ঘটনা ঘটেছিল ফেরি ছাড়তে বিলম্ব করায় ফেরির ভেতরে একটা ছেলে মারা গেছেন। এ রকম একটা ঘটনার নিউজ কাভারেজ হয়েছে। কিন্তু সব ঘটনা তো নিউজে আসে না। এই সেতু চালু হলে সেই বিড়ম্বনা দূর হবে।
ঢাকাপ্রকাশ: সেতু চালু হলে আপনার সংসদীয় এলাকা থেকে কোন কোন ফসল বা পণ্য সরাসরি ঢাকায় ঢুকবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?
এসএম শাহজাদা: আমাদের এলাকা থেকে ঢাকায় আসার মতো রয়েছে মাছ, চাল, এবং মৌসুমী ফল। বিশেষ করে তরমুজ। আমাদের এলাকার তরমুজ সারা দেশের মানুষের চাহিদার সিংহভাগ মিটিয়ে থাকে। সেতু চালু হওয়ার আগে কৃষক তরমুজ তার খেত থেকে তুলে প্রথমে একটা ট্রলারে করে ডাঙ্গায় আনত। এরপর ট্রাক ভর্তি করে সেই পণ্যে ঢাকায় পৌছাতে সড়ক পথে দুই থেকে তিন দিন লাগতো। এখন দিনে দিনে ঢাকায় চলে আসবে। আগে প্রতিটি তরমুজ ঢাকায় পৌঁছাতে পরিবহণ খরচ হতো ২০ টাকা, এখন খরচ ৪ থেকে ৫ টাকা। পাশাপাশি দ্রুত সরবরাহ করতে পারলে কৃষকও ভালো দাম পাবে। আমি মনে করি, আগামী বছর ঢাকার মানুষ কম দামে তরমুজ খেতে পারবে। শুধু ঢাকায় পণ্য আসবে তা না, ঢাকার মানুষ আমাদের এলাকায়ও যাবে।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনি কি মনে করছেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের দীর্ঘ দিনের অবহেলার অবসান ঘটতে যাচ্ছে?
এসএম শাহজাদা: অবশ্যই অবহেলার অবসান ঘটতে যাচ্ছে পদ্মাকে ঘিরে। যখন কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা হয়ে যাবে সেতুর পাশাপাশি ট্রেন চালু হবে তখন ফেরির জন্য নির্দিষ্ট সময় ধরে বসে থাকতে হবে না। যখন তখন রওয়ানা দিতে পারবে মানুষ।
ঢাকাপ্রকাশ: এই সেতুকে ঘিরে আপনার এলাকার মানুষের উচ্ছ্বাস কেমন?
এসএম শাহজাদা: আমি নির্বাচিত হওয়ার পর আমার এলাকার জনগণকে ভালো সেবা দেওয়ার জন্য বিআরটিসির এসি বাস দিয়েছিলাম আমার দুই উপজেলায়। এটা তিন মাসের মধ্যে লোকসান দিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু যখন উদ্বোধন করেছিলাম শত শত মানুষ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে তারা ঢাকায় আসবে। কিন্তু ফেরিঘাটে এসে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে হয় তখন তারা অস্থির অবস্থায় পড়ে যায়। বাস পরিচালনাকারী সংস্থা লোকসান গুণতে শুরু করে। পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। সেতু চালু হওয়ার পর আবারও বাসে বিলাসবহুল ভ্রমণটা হবে।
ঢাকাপ্রকাশ: পদ্মা সেতু চালু হলে আপনাদের অঞ্চলে কোন কোন ব্যবসার নতুন দ্বার খুলবে?
এসএম শাহজাদা: সেতু চালু হলে অনেক কিছুর জন্যই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে ঢাকায় আসতে হবে না বরং ঢাকা থেকে সেবাটা ওখানে পৌঁছে যাবে। উদাহরণ দিয়ে বলি, ঢাকায় নামী দামি ব্রান্ডের খাবারগুলো শুধুমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আমাদের অঞ্চলে কোন ব্রাঞ্চ খোলে না। আমার সঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠানের কথা হয়েছে। তারা ২৫ জুন সেতু উদ্বোধনের পর ২৬ জুন থেকেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্রাঞ্চ খুলতে চায়। কুয়াকাটার পর্যটন কেন্দ্রের অপার সম্ভাবনা। আমি জানি প্রাইভেট সেক্টরের অনেকে জমি কিনে রেখেছেন, যারা সেতু চালু হলেই সেখানে ব্যবসা চালু করবেন। ঢাকা থেকে লোকজন যাবে।এর মাধ্যমে আমার এলাকার লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে আমাদের এলাকা।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনার এলাকায় এমন কিছু কি আছে যেটা এখনই করতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে বেশি অবদান রাখতে পারবে?
এসএম শাহজাদা: মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র করা যেতে পারে। মৎস্য এক্সপোর্ট করার জন্য এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন করার ব্যবস্থা করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। অটো রাইস মিল হবে। গবাদি পশুর খামার করলে বিরাট সম্ভবনা দেখা দেবে। এক কথায় যোগাযোগ ব্যবস্থা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো অর্থনীতিতে ক্লিক করবে।
ঢাকাপ্রকাশ: পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের উৎসবটা কি দলমত নির্বিশেষে হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
এসএম শাহজাদা: আমাদের টার্গেট আছে প্রতি উপজেলা থেকে টার্গেট পিপুলকে লঞ্চে করে সভাস্থলে নিয়ে আসব। স্মরণকালের সর্বোচ্চ জনসমাবেশ হবে। ১৫ থেকে ২০ লাখও হয়ে যেতে পারে। তবে এই উদ্বোধন নিয়ে নিন্দুক যারা আছেন তাদের উদ্দেশে একটা গল্প বলি, ‘চামচিকা দিনের আলোতে বের হয় না, যে কারণে সূর্যের আলো সে দেখতে পায় না। তাতে সূর্যের আফসোসও নাই এবং সূর্য ক্ষতিগ্রস্তও হয় না। চামচিকা সূর্য অস্ত যাওয়ার পর বের হয়। এই ধরনের চামচিকা শ্রেণির যারা আছেন তারাও উৎসব করবেন। কিন্তু তারা হয়তো সন্ধ্যার পর করবেন, আমরা দিনে করব। যারা নেত্রীকে ভালোবাসি, দেশকে ভালোবাসী যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক আমরা উৎসব দিনে করব ওরা হয়তো রাতে করবে।
এনএইচবি/এমএমএ/