পদ্মার বুকে দিগন্তজুড়ে স্বপ্নের সেতু
তুখোড় স্রোত। এপার থেকে ওপার চোখে দেখা যায় না। ভাঙনের খেলায় মেতে থাকে সর্বনাশা পদ্মা। কত শত, হাজার মানুষকে জলে চাপা দিয়ে নিঃস্ব করেছে, সেই হিসেব আঙুলের কড় গুণে বের করা অসম্ভব। ঢেউয়ে ঢেউয়ে বিলীন হয়েছে কত জীবনের রঙ ও স্বপ্ন। সুরে সুরে তাই পদ্মাকে নিয়ে কত শিল্পী কণ্ঠে তুলেছে বিরহী গান...‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’।
আর কয়েকদিন পর এগুলোকে রূপকথার গল্প বলে মনে হবে। কারণ, মানুষের কাছে যা ছিল স্বপ্নের চেয়েও বেশি, সাধ্যের একেবারেই বাইরে এবং কল্পনাতীত। সেই স্বপ্ন ও সাধ পূরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সর্বনাশা পদ্মাকে শান্ত করে তিনি মানুষের স্বপ্ন পূরণ করেছেন নিষ্ঠায়, কাজে ও কর্মে। খরশ্রোতা হিংস্র পদ্মা নদীর বুকে দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এখন জীবন্ত এক সেতু। যার নাম ‘পদ্মা সেতু’।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠিকে একসুতোয় বেঁধে রাখবে এই সেতু। ভিনদেশিদের চাপ, দেশীয় ষড়যন্ত্র সব উপেক্ষা করে এককভাবে বাংলাদেশের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে প্রাণের এই সেতু। যা বলিষ্ঠ হাতে নির্মাণ করিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ফেরী পারাপারের অপেক্ষা করে আর কোনো রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে অকালে চলে যেতে হবে না। চোখের পলকেই উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে আসতে পারবে পদ্মার বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেতুর হাত ধরে। আর কোনো সন্তানকে মায়ের মৃত্যুর খবর শুনেও সময়মত না পৌঁছানোর আক্ষেপ বয়ে বেড়াতে হবে না সারাজীবন। সবকিছুর সমাধান হয়ে গেছে। অপেক্ষা আর মাত্র কয়েকটা দিনের।
একটা সেতু শুধুই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে নয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গোটা দেশের মানুষ হৃদয় বেঁধেছে আবেগে ও শ্রদ্ধায়।
আগামী ২৫ জুন সকালে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই সেতুকে ঘিরেই নতুন উদ্যমে স্বপ্ন বুনছেন খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার মানুষরা।
সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে নতুন নতুন বাস সার্ভিস চালু করবেন বাস মালিকরা। টোল নিয়ে কিছু মানুষের মাঝে সমালোচনা থাকলেও বাসের ড্রাইভার, হেলপার ও যাত্রীদের মাঝে দুশ্চিন্তা নেই এক বিন্দুও। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে তা ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ফেরিঘাটের দোকানিরাও ভীষণভাবে আনন্দিত এজন্য। তাদের বক্তব্য-পদ্মা সেতুর কারণে পর্যটন শিল্পেও বিপ্লবের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। আগের চেয়েও ব্যবসা-বাণিজ্য জমে উঠবে দ্বিগুণ। বর্ষায় পদ্মার উন্মত্ততায় দিশেহারা হয়ে পড়তো দক্ষিণাঞ্চলের লাখো লাখো মানুষ, সেই পদ্মাকে ঘিরেই এবার তারা ঝলমলে এক সমৃদ্ধ ও সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন আঁকছে।
তবে, ফেরিতে কাজ করা শ্রমিকদের মনে ঘাট বন্ধ হয়ে যাবার কিছুটা শঙ্কা থাকলেও তা খুব ঠুনকো। পদ্মা সেতু নির্মাণ হওয়ায় তাদের ভয়ের চেয়ে আনন্দের পাল্লাটাই ভারী। তাদের মুখে একটাই কথা-ঘাট হয়তো এখানে আর থাকবে না। আমাদের অন্যত্র চলে যেতে হবে। কিন্তু এ সেতুর কারণে মানুষের বিষাদী-দুর্ভোগ বন্ধ হবে আজীবনের জন্য।
এএম/এনএইচবি/এমএমএ/