সম্ভাবনার নতুন দুয়ার পদ্মা সেতু-১৩
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘটতে যাচ্ছে শিল্পবিপ্লব
‘পদ্মা সেতু’ সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় পদ্মার এপার-ওপার বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রাখবে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এই সেতু।
এক পদ্মা সেতুর কারণেই বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে থাকা ২১টি জেলার আর্থ-সামাজিক চিত্র। যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেমন পদ্মা সেতু পুরো দেশকে এক সুতোয় বাঁধতে যাচ্ছে, তেমনি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জেলাগুলোতে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠার অপরা সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
আগামী ২৫ জুন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত দেশের অন্যতম এই স্থাপনা এই
সেতুর কল্যাণেই চেহারা বদলে যাবে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর এবং রাজবাড়ী জেলার। এসব জেলায় শুধু যে শিল্প কারখানা হবে তাই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন খাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পদ্মা সেতু হচ্ছে দেখে চট্টগ্রামের কারখানা বিক্রি করে বাগেরহাটে কারখানা করছেন বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন।
তার মতো আরও অনেকেই পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা দেখে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাতেই নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে তুলার কাজে হাত দিয়েছেন। শিল্পায়নের নতুন নতুন স্বপ্ন দেখছেন। পদ্মা সেতুর কারণে ওই ২১ জেলায় অনেক উদ্যোক্তা প্রস্তুতি নিচ্ছেন শিল্প কারখানা গড়ে তোলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নে ভূমিকা রাখছে মংলা বন্দরে তার সুফল এখনই পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সেখানে বেশ কয়েকটি সিমেন্ট কারখানা চালু হয়ে গেছে। গার্মেন্টসহ নানা ধরনের রপ্তানীমুখী শিল্পকারখানাও গড়ে উঠতে শুরু করেছে।
জানা যায়, ২০৫ একর জমি নিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে মংলায়। ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং খুলনার খালিশপুরে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক জোনের সীমানা নির্ধারণ হয়ে গেছে। খুলনায় আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ইপিজেডগুলো। চাহিদামতো গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল।
পদ্মা সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল তাদের এক স্টাডি রিপোর্টে বলেছে, সেতুর বোনফিট কস্ট রেশিও (বিসিআর) ১ দশমিক ৭ এবং ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (ইআরআর) ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই সেতু নির্মাণ অর্থনৈতিক বিবেচনায় লাভ হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি ২ শতাংশ এবং দেশের সার্বিক জিডিপি ১ শতাংশেরও বেশি বাড়বে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণের ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নতি হবে। সেতুটি ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে (এন-৮) এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ফলে সেতুর উভয়পার্শে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও প্রাইভেট শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে।
মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর সেতুর কারণে সচল হবে। পর্যটন শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ, মাওয়া ও জাজিরা পাড়ের রিসোর্টগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকবে।
সম্প্রতি পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্বালানি চাহিদা নিশ্চিত হলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যুগান্তকারী উন্নয়ন হবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মংলার গতিশীলতা বাড়বে। ফলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে এই বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিতে আগ্রহী হবে।
একইভাবে গুরুত্ব বাড়বে পায়রা বন্দরেরও। এই বন্দর দিয়ে ভুটান, নেপাল ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বাড়বে।
খুলনা চেম্বারের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প হলো হিমায়িত মৎস্য ও পাট। এই খাতের অধিকাংশ পণ্য খুলনা বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়। পদ্মা সেতুতে রেল সেতু চালু হলে গতিশলিতা আরও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি কাজী আমিনুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্যন্নয়ন ঘটাতে নতুন শিল্পায়নের যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে তার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্যাস ও খানজাহান আলী বিমানবন্দর। গ্যাস ও বিমানবন্দর চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন হবে। গতি ফিরবে অর্থনীতির।
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডি এ বাবুল রানা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য কল-কারখানা। মংলা বন্দর পর্যন্ত দুইপাশে এখন কোথাও জমি পাওয়া যায় না। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিল্প কারখানার মালিকরা সেখানে জমি কিনে রেখেছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও বলছেন, পদ্মা সেতু এই অঞ্চলে বিনিয়োগ, রপ্তানি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সহায়তা করবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে।
আরইউ/এনএইচবি/