সম্ভাবনার নতুন দুয়ার পদ্মা সেতু-১০
সেতুর সঙ্গে নৌপথের তুলনা কতটুকু যৌক্তিক
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জন্য অপার সম্ভবনার দুয়ার বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু খুলছে আগামী মাসেই। এই সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষের কাছে ঢাকা চলে যাবে আরও নিকটে। ঢাকার সঙ্গে তাদের দূরত্ব কমে যাবে অনেক। পদ্মা সেতু কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন সেক্টরে সম্ভবনার দুয়ার উন্মোচিত হলেও সংকটে পড়বে নৌপরিবহন সেক্টর। বিশেষ করে দক্ষিণ পশ্চিমের জেলাগুলোতে চলাচলকারী লঞ্চ-ফেরি অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।
সেতু চালু হওয়ার খবরে লঞ্চ মালিকদের অনেকেই কপালে শনির দশা দেখছেন। এমনিতেই দেশের নৌপথ সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় ব্রিজ হওয়ায় তাদের জন্য সর্বনাশ হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অনেক লঞ্চ মালিক পথে বসে যাবেন। অনেকে এরইমধ্যে বিকল্প ব্যবসা খুঁজতে শুরু করছেন। তবে কতটা প্রভাব পড়বে সেটা এই মুহুর্তে বিশ্লেষণ করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। কারণ তারা মনে করছেন সেতু চালু হওয়ার পর যদি মানুষ নির্বিঘ্নে চলে যেতে পারে তাহলে কেউ নৌপথে আসতে চাইবে না। আর যদি তীব্র যানজট হয় তাহলে হয়তো অনেকেই নৌপথকেই বেছে নেবে। সেটা চালু হওয়ার পর বোঝা যাবে।
তবে সেতু চালু হওয়ার খবরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষ স্বপ্ন বুনতে শুরু করছে। অনেকেই বলছেন এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি ঘাটে বসে থাকতে হবে না। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে দুপুরেই ঢাকায় পৌঁছাব। এই স্বপ্ন দেখছেন অনেকেই। সেতু চালু হওয়ার কথা শুনে বাগেরহাটের ফয়েজ আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ফেরির সঙ্গে সেতুর তুলনা করা ঠিক হবে না। তার যুক্তি আমি যদি বাড়ি থেকে বাঁধাহীন ভাবে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে আসি তাহলে লাগবে ৪ ঘণ্টা, ফেরিঘাটে ফেরি থাকুক আর না থাকুক তাতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা নষ্ট হবেই। আর যদি বাগেরহাট সদর থেকে গাড়ীতে উঠি তাহলে পদ্মা সেতুর জাজিরাপ্রান্তে আসতে সময় লাগবে আড়াই ঘণ্টা। অর্থাৎ এখানেই সময় কমবে দেড় ঘণ্টা আর ফেরি পার হতে যে তিন থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা নষ্ট হতো সেটি আর হচ্ছে না। সেতু পার হতে যদি ৭ মিনিট লাগে তাহলে আমি ঢাকায় পৌছাবো সর্বসাকুল্যে ৩ ঘণ্টায়। অর্থাৎ আমি চাইলে সকালে বাড়ি থেকে এসেই অফিস করতে পারব।
এটি শুধু সাধারণ তথ্য। তা ছাড়া ফেরিঘাটে আরও যেসকল দুর্ভোগ রয়েছে। ঝড় উঠলে ফেরি বন্ধ, কুয়াশা হলে ফেরি বন্ধ, স্রোত থাকলে ফেরি বন্ধ, নদী ভাঙন হলে ফেরি বন্ধ। ঘাটে ভিআইপিদের পদচারণা থাকলে ঘাট পাওয়ার বিড়ম্বনা। এরকম শত বিড়ম্বনা রয়েছে। সুতরাং সেতুর সঙ্গে ফেরির তুলনা করা কখনই যৌক্তিক না বলে দাবি করেন ফয়েজ।
শুধু বাগেরহাটের ফয়েজ না শরীয়তপুরের মিজানুর রহমানেরও একই দাবি। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ফেরি ঘাটের দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্ভোগ তো রয়েছেই। তা ছাড়া লঞ্চ ডুবির মতো বড় বড় ঘটনা মাঝে মাঝেই থাকে। সুতরাং ফেরির সঙ্গে সেতুর তুলনা করা নির্বোধের মতো।
যারা নৌপথে ভ্রমণ করতে চাইবে তাদের জন্য হয়তো ফেরি একটা ভ্রমণ বিলাস বাহন হবে। তাছাড়া ফেরিতে কেউ উঠতে চাইবে না। দক্ষিণ পশ্চিমের জেলাগুলোর মানুষ নদী পার হওয়ার জন্য বিগত ৫০ বছরের দুর্ভোগ নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। নদী পার হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকায় অনেক অসুস্থ মানুষ যাত্রাপথেই মারা গেছেন- এমন ঘটনাও কম না। তা ছাড়া জরুরি প্রয়োজনে অনেকে ঢাকা আসতে গিয়ে পড়েছেন বিড়ম্বনায়। সেটি মুহুর্তেই চলে যাবে। এসব দিক বিবেচনা করলে পদ্মা সেতু শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয় মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দেবে।
এদিকে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার খবরে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন লঞ্চ মালিকরা। এ বিষয়ে লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুবউদ্দিন বীরবিক্রম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘সেতু চালু হলে কি হবে না হবে সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। যারা যাওয়া আসা করবে তাদের রেসপন্সটা কি হয় তার উপর নির্ভর করবে। তারপর আসা যাওয়ার মধ্যে রাস্তায় যানজট হয় কি না, বাড়ে না কমে অনেক ফ্যাক্টর আছে। ব্রিজে উঠার সময় যদি যানজট হয়, নামার সময় যদি যানজট হয়, লম্বা যানজট যদি হয় তাহলে এক রকম হবে, আর যদি স্মুথ হয়ে যায় তাহলে আরেক রকম হবে। এই মুহুর্তে নির্ণয় করা জটিল।’
সংকট তৈরি হবে কি না জানতে চাইলে বলেন, বড় জাহাজগুলোতে যে ভিআইপি কেবিনে লোকজন আসত সেগুলো তো কমে যাবে। লোকজন কমে গেলে জাহাজের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে যাবে। সেতু চালু হলে ঘাট পরিবর্তন হবে কি না জানতে চাইলে বলেন, ঘাট পরিবর্তনের ব্যাপার সরকার জানে। পদ্মা সেতু করাই হয়েছে ঘাট যাতে না লাগে। পদ্মা সেতু হলে ঘাট উঠে যাবে এটাই স্বাভাবিক। শিফট হয়ে যাওয়ার মতো জায়গা থাকলে শিফট হবে, না হলে মাঠেই মারা যাবে। কোথাও নতুন পয়েন্ট সৃষ্টি হলে হয় তো ফেরি সেখানে যাবে। তত দিনে জাহাজ নষ্ট হয়ে যাবে। বর্তমানে বেসরকারিভাবে বড় জাহাজ রয়েছে ৬০-৭০ টি।
এছাড়া সরকারিভাবে ৫১ টি ফেরি রয়েছে। এসব ফেরি দিয়ে মাওয়া-জাজিরা ঘাটে যানবাহন পারাপার হতো। সেতু চালু হলে এই সকল ফেরি কোথায় যাবে সেটি এখনও নির্ধারণ করেনি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। তবে সেতুর নিচ দিয়ে যেন ফেরি চলাচল করতে না পারে তার জন্য বিধিনিষেধ আছে। তাই অচিরেই ঘাট পরিবর্তন হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
তা ছাড়া দক্ষিণ পশ্চিমের জেলাগুলোতে বিশেষ করে বরিশাল, মাদারিপুর, গোপালগঞ্জ, শরিয়াতপুর, পিরোজপুর, পুটয়াখালি, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, রাজবাড়ীসহ প্রায় ২২ টি জেলার মানুষ উপকৃত হবে। শুধু তাই না মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। পুরো এলাকার অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে যাবে।
এসএম/এনএইচবি/এমএমএ/