টাকা না দিলে ফিটরাও আনফিট
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবার আতাউর রহমানের ছেলে ফরহাদ হোসেন ফাহিম। সৌদি আরবের ভিসা পেয়ে যান মেডিকেল পরীক্ষা করার জন্য নির্ধারিত এলাইড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। মেডিকেল পরীক্ষার পর তাকে সেখান থেকে দেওয়া হয় এইচআইভি পজিটিভ রেজাল্ট। এই রেজাল্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সৌদি দূতাবাসে। বাতিল হয়ে যায় ফাহিমের ভিসা। রেজাল্ট দেখে বিস্মিত হয়ে যান ফাহিম। লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারেন না। এলাকায় সামাজিক ভাবেও নিগৃহীত হতে থাকেন। এরপর তার মাকে নিয়ে আবারও আসেন ঢাকায়। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইসিডিডিআরবিতে আবারও পরীক্ষা করেন। সেখানে পরীক্ষায় এইচআইভি নেগেটিভ দেখানো হয়। এই রিপোর্ট নিয়ে পরবর্তীতে এলাইডে গেলে শুরু হয় নানা ধরনের টালবাহনা। এক পর্যায়ে টাকা দাবি করে বসে তারা।
শুধু ফাহিম নয়, এ রকম ভাবে বিদেশগামীদের কাছ থেকে মেডিকেল টেস্টের নামে বাণিজ্য করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। যারা টাকা দিতে পারেননা তাদের আনফিট দেখানো হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের অর্থনীতির চাকা অনেকটা সচল থাকলেও, পদে পদে হয়রানি, প্রতারণা, দালালদের দৌরাত্মে নানা ভোগান্তির শিকার হন বিদেশগামীরা।
শ্রমিকদের বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে মেডিক্যাল চেক-আপ বাধ্যতামূলক। দেশে সরকারি-বেসরকারি, নামী-দামী বা বিশ্বমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা বিভিন্ন মেডিকেল সেন্টার থাকলেও, হাতে গোনা কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করানো হয় বিদেশ গমনেচ্ছুদের মেডিকেল টেস্ট। এসব মেডিকেল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার একটি সিন্ডিকেটের হাতে থাকায় ভোগান্তির অন্ত নেই সেবা প্রার্থীদের। গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল অ্যাপ্রুভড মেডিকেল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন-গামকা ও অন্যান্য মেডিকেল সেন্টরাগুলোতে দুর্দশা এবং শ্রমিক ভোগান্তির কোনো শেষ নেই।
নিয়মানুসারে মেডিকেল টেস্টে এইচআইভি (এইডস), খুব বেশি চর্মরোগ, জন্ডিস, হার্টের সমস্যা এবং শ্বাসকষ্ট এসব রোগের লক্ষণ থাকলে বিদেশ গমনেচ্ছুদের আনফিট দেখানো হয়। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ শরীরে এসব রোগ না থাকলেও ইচ্ছা করে ভুল রিপোর্ট দিয়ে সেবা প্রত্যাশীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে মেডিকেল সেন্টার গুলো।
সূত্র মতে, মধ্যপ্রাচ্যে গমনেচ্ছুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারগুলোর সমন্বয়কারি সংস্থা হল গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল অ্যাপ্রুভড মেডিকেল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন-গামকা। তবে প্রবাসীরা এর নাম দিয়েছেন গরীব মারার কারখানা। গামকা সিন্ডিকেট ও দালালদের দৌরাত্ম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও, অবস্থার উন্নতি হয়নি।
দরিদ্র গ্রামীণ সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে গামকা। গামকার ভেতরে বাইরে রয়েছে শত শত দালাল। ছবি তোলার নামে ইচ্ছামত টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ডাক্তার, নার্স বা টেকনিশিয়ান ছাড়াই বিদেশ গমনেচ্ছুদের মেডিকেল টেস্টের নামে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মেডিকেল সেন্টার নামধারী একশ্রেণির প্রতিষ্ঠান।
মেডিকেল ফিটনেস কার্ড সংগ্রহের প্রতিটি ধাপে ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হতে হয় বিদেশগামীদের। সাধারণ মেডিকেল পরীক্ষায় এক হাজার টাকা খরচ হলেও গামকায় নেওয়া হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা।
দেশে মানসম্মত সরকারি- বেসরকারি অনেক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও বিদেশ গমনেচ্ছুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়েছে মাত্র ৪৬টিকে। প্রতিজনের কাছ থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে আদায় করা হয় ৫ হাজার ৮৫০ টাকা করে।
রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, এক্স-রে সহ কয়েকটি পরীক্ষার জন্য এই টাকা আদায় করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরীক্ষাগুলো বাইরের কোন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে করালে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা লাগার কথা। টাকা না দিলে অনফিট করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ি প্রতিটি সেন্টারে পুরুষ-মহিলা ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোন মেডিকেল সেন্টারেই মহিলা ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান পাওয়া যায়নি।
আল ফালাহ মেডি-কম ক্লিনিক। রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত এই সেন্টারটির বিরুদ্ধে রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগ। এখানে অতিরিক্ত টাকা ছাড়া মেলে না ফিটনেস কার্ড।
সেবা প্রার্থীদের এমন অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মহিলাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন পুরুষ চিকিৎসক। তবে মানুষের অভিযোগ ও নিয়ম নীতির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন কর্মরত ডাক্তার ও মালিক।
রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত এস. কে. এন. হেলথ সার্ভিস। এই সেন্টারটির বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। নেই নারী ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান। এছাড়া, নির্ধারিত সময়ে ফিটনেস কার্ড না দেওয়ায় বিপাকে পড়তে হয় অনেককে। রাজধানীর ফকিরাপুল, পল্টন, আরামবাগসহ আশপাশে রয়েছে অসংখ্য মেডিকেল সেন্টার নামধারী অর্থ উপার্জনের প্রতিষ্ঠান। কোন ডাক্তার বা টেকনিশিয়ান ছাড়াই এখান থেকে দেওয়া হয় রিপোর্ট।
ইউরো-বাংলা ডায়াগনেস্টিক সেন্টার। বাহারী নাম হলেও কাজ পুরোই উল্টো। ল্যাব ছাড়াই দেওয়া হয় রিপোর্ট। একটি এক্স-রে মেশিন থাকলেও, কবে এটি শেষ কবে চালু হয়েছিলো সেটি হয়ত জানা নেই কারোরই। রিসিপশনিস্ট শারমিন আক্তারই সব। তার হাতেই তৈরি হয় রিপোর্ট। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ফকিরাপুলের অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারদের সীল ব্যবহার করে ইচ্ছামত মেডিকেল রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। ফকিরাপুলে অর্ধশত মেডিকেল সেন্টার এমন প্রতারণার ব্যবসায় জড়িত। কোন ধরণের পরীক্ষা নিরিক্ষা ছাড়াই মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট দিচ্ছে তারা।
টাকা না দিলে সুস্থদেরও আনফিট করে দিচ্ছে মেডিকেল চেকআপ সেন্টারগুলো। টাকা দিলে অসুস্থ ব্যক্তি ফিট, না দিলে সুস্থরাও আনফিট। মধ্যপ্রাচ্যগামী বেশিরভাগ কর্মীর সঙ্গে এমন প্রতারণা করছে বেশিরভাগ মেডিকেল চেক আপ সেন্টার। শুধু তাই নয়, জন্ডিস, যক্ষাসহ কঠিন রোগে আক্রান্ত অনেকে টাকার বিনিময়ে ফিট কার্ড নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। এ বিষয়ে নেই সরকারি নজরদারি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিদেশ যাত্রার স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রনায় অশ্রুশিক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আহসান হাবীব। সচ্ছলতার আশায় জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে, যেতে চান সৌদি আরবে। ভাটারা মোহায়মিদ মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করান। কিন্তু তাকে আনফিট করা হয়। পরে ২৩ হাজার টাকায় ফিট হন আহসান। অপরদিকে টাকা দিতে না পারায় কুড়িলের ট্রান্সওয়ার্ল্ড মেডিকেল সেন্টারের বিরুদ্ধে আনফিট করার অভিযোগ তোলেন বিদেশগামী ফরহাদ।
প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় দেশের অর্থনৈতিক ভিত শক্ত হচ্ছে, পারিবারিক জীবনে ফিরছে স্বচ্ছলতা। অথচ ঠুনকো সমস্যা বা ঘুষ না দিতে পারায় প্রতিদিন শত শত বিদেশগামীর স্বপ্ন ভাঙছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বরাবরের মত বক্তব্য দিয়েই দায় সারছেন। তারা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা এ ধরনের বেআইনি কাজে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবে অধিদপ্তর। মুখে মুখে এমন কথা বলা হলেও কাজে তার বিন্দুমাত্র বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়না বলে অভিযোগ ভুক্তোভোগীদের।
কেএম/এএস