সম্ভাবনার নতুন দুয়ার পদ্মা সেতু-৫
দূরত্ব কমছে ৩ ঘণ্টা, কলকাতায় উচ্ছ্বাস
পদ্মা সেতু নিয়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মানুষদের মধ্যেও উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কলকাতার ব্যবসায়ীরাও উচ্ছ্বসিত। পদ্মা সেতু চালু হলে দূরত্ব কমবে। সহজ হবে যোগাযোগ। বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য।
কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ ২৭ মে ‘কলকাতা থেকে ঢাকা আরও সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় কমছে, জুনে খুলে যাচ্ছে পদ্মা সেতু’ শিরোনামে একটি চিত্র সংবাদ প্রকাশ করে। এতে ১৭টি আলোকচিত্র যুক্ত করা হয়।
সংবাদে বলা হয়েছে, ‘কলকাতা থেকে ঢাকার দূরত্ব দেড়শো কিলোমিটার কমছে! আগে এপার বাংলার রাজধানী থেকে ওপার বাংলার রাজধানীতে পৌঁছতে ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে হত। জুন মাসের শেষের দিকে ২৫০ কিলোমিটার গেলেই চলবে। নাহ্, ঢাকা উড়ে কলকাতার কাছে আসছে না! কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থানও বদলাচ্ছে না। বদলাচ্ছে যোগাযোগের সেতু। পদ্মা নদীর উপর যে সেতু গড়ার স্বপ্ন গত দশ বছর ধরে দেখে আসছে বাংলাদেশ।’
পদ্মা সেতু চালু হলে দূরত্ব কমে যাওয়া তথ্য দিয়ে বলা হয়, ‘এখন কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস কলকাতা স্টেশন থেকে নদিয়া পেরিয়ে যায় গেদে। গেদে থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত স্টেশন দর্শনা পার করে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছয় ১০ ঘণ্টায়। ৪০০ কিলোমিটারের লম্বা রাস্তা। পদ্মা সেতুর রেললাইন ধরে ঢাকা পৌঁছতে হলে কলকাতা থেকে বনগাঁ জংশন হয়ে হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে বেনিয়াপোল, যশোর, নড়াইল, ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে শুধু ২৫১ কিলোমিটার পথ যেতে হবে।’
পদ্মা সেতুর গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়, ‘তা বলে যদি মনে করেন, কলকাতাকে ঢাকার কাছাকাছি আনতেই নদীর উপর সার সার পিলার গেঁথে প্রায় ১০ কিলেমিটার দীর্ঘ সেতু বানাচ্ছে বাংলাদেশ, তবে মস্ত ভুল হবে। প্রায় ১০ হাজার কোটি বাংলাদেশি মুদ্রার ব্যয়বহর সামলে তৈরি করা এই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)কে এক ধাক্কায় ১.২ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে পারবে বলে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা।’
সেতুর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। বলা হয়, ‘তবে শুধু তা-ই নয়, পদ্মা সেতুর নকশায় বেশ কিছু বিরল বিশেষত্ব রয়েছে। যা গোটা দুনিয়ার কাছেও বাংলাদেশকে শ্রেষ্ঠত্বের খ্যাতি এনে দিয়েছে। এটি আসলে দোতলা সেতু। এর একতলায় অর্থাৎ নদীর কাছাকাছি চলবে ট্রেন। সামান্য উপরে চার লেনের চওড়া রাস্তায় চলবে সব রকম গাড়ি। নদীর কাছাকাছি হলেও রেল ব্রিজ থেকে জলের দূরত্ব থাকবে অন্তত ১৮ মিটারের। ফলে জলস্তর বাড়লেও এই ব্রিজের তলা দিয়ে পাঁচতলা সমান জাহাজের যাতায়াতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’
আরও বলা হয়, ‘পদ্মা সেতুকে জলের মধ্যে ধরে রাখবে ৪০টি পিলার বা স্তম্ভ। প্রত্যেকটিই তৈরি হয়েছে মজবুত পাইল ইস্পাত দিয়ে। তবে এর পাশাপাশি এই পিলারের আর একটি বিশেষত্ব রয়েছে। জলের নিচে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে গিয়েছে এই পিলারের ভিত। পৃথিবীর আর কোনো দেশে আর কোনো সেতুর স্তম্ভ এত গভীরে নেই। নিরাপত্তার আর একটি ব্যবস্থা পদ্মা সেতুর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ পৃথিবীর অন্য সব সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। প্রায় ১০ হাজার টন। এই ক্ষমতায় এই সেতু রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও অনায়াসে টিকে যাবে।’
‘শুধু বাংলাদেশই নয়, পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচনের দিকে তাকিয়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষও। নিজ দেশের যোগাযোগ বন্ধন শুধু নয়, ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সেতুবন্ধন হিসেবে বড় ভূমিকা রাখবে এ সেতু। পাশাপাশি উপমহাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। এমনটাই মনে করছেন ভারতের ব্যবসায়িক সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনরা।’ বৃহস্পতিবার (২৬ মে) কলকাতায় দিনব্যাপী ‘ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর বিষয়টি আলোচিত হয়। সময় টিভির কলকাতা প্রতিনিধি সুব্রত আচার্য প্রেরিত ‘পদ্মা সেতুর জন্য মুখিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় এ সব তথ্য।
সুব্রত আচার্য লিখেছেন, ‘২০১৪ সালের নভেম্বরে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখন অপেক্ষা স্বপ্ন ডানা মেলার। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়াবাসীই শুধু নয়, পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন নিয়ে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা আসছে ভারতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতাদের আলোচনায়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পদ্মা সেতু বাংলাদেশের বড় অর্জন। আর এ অর্জনকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টাকে অভিনন্দন জানাতে চান পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও। অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি বড় উন্নয়নশীল দেশ। বিপুল জনসংখ্যা নিয়েও বাংলাদেশকে যে উনি (শেখ হাসিনা) এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন, এজন্য ওনাকে ধন্যবাদ।’
অনুষ্ঠানে পশ্চিম বঙ্গের সমবায় উন্নয়নমন্ত্রী অরুপ রায় বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকে তাদের সঙ্গে আমাদের আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশ-ভারত যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে।’
‘শুধু নিজ দেশের যোগাযোগ বন্ধন নয়, পদ্মা সেতু ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সেতুবন্ধন হিসেবে বড় ভূমিকা রাখবে’ বলে মনে করছেন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সংগঠন ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি প্রদীপ সুরেকা।
উপ-রাষ্ট্রদূত আন্দালিব ইলিয়াস বলেন, ‘পদ্মা সেতু আগামী ২৫ জুন চালু হলে সেটির ইতিবাচক প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক ও অর্থনীতিতে পড়বে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বেসরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ছয় থেকে সাত হাজার বাংলাদেশি পর্যটক ভারতে প্রবেশ করেন। যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই থাকেন কলকাতায়। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে যাতায়াতে সময় বাঁচবে প্রায় ৪ ঘণ্টা। এমনটা হলে কলকাতায় আসা বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যাও দ্বিগুণ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।’
‘পদ্মা সেতুর খবরে কলকাতাতেও আনন্দের বন্যা’ শিরোনামে সুব্রত আচার্যের আরেক সংবাদে বলা হয়, ‘ঢাকা থেকে কলকাতা পৌঁছাতে বাসে সময় লাগে প্রায় ১২ ঘণ্টা। এর মধ্যে শুধু দৌলতদিয়া ফেরি পারাপারেই সময় চলে যায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা। সেই সঙ্গে আছে ঘাট এলাকার যানজটের দুর্ভোগ। প্রতিদিন গড়ে ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচল করে ছয়টি পরিবহনের ৩০টি যাত্রীবাহী বাস। এসব যানবাহনে প্রতিদিন গড়ে যাতায়াত করেন প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি ও ভারতীয় পর্যটক।’
‘মূলত বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করেই এত দিন টিকে ছিল কলকাতার নিউমার্কেট, সদর স্ট্রিট, পার্ক-স্ট্রিটসহ বাংলাদেশি হোটেলপাড়া খ্যাত বিভিন্ন এলাকার অর্থনীতি। এবার পদ্মা সেতুর কারণে সেই অর্থনীতি আরও চাঙা হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন কলকাতার ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পাশাপাশি এই সেতু ভারতের অর্থনীতিতেও বড়সড় প্রভাব ফেলবে বলে মত তাদের।’
বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু আগামী ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। বহুমুখী এই সড়ক ও রেল সেতুর দূরত্ব ছয় দশমিক ১৫ কিমি। এই সেতুর মাধ্যমে দেশের তিন বিভাগের ২১ জেলা মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে। খরস্রোতা পদ্মা নদীর উপর ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হচ্ছে স্বপ্নের এ সেতু। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
এপি/আরএ/