সাক্ষাৎকার/চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাস্তবসম্মত বাজেট চাই
নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা চলছে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। বলা হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুরে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও । এতে সাধারণ মানুষ আছে চরম অস্বস্থিতে। কিন্তু এথেকে উত্তরণ প্রয়োজন। সাধারণ মানুষকে স্বস্থি দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। আসন্ন বাজেটে সেজন্য থাকতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা। আগামী বাজেটে কিভাবে ভোক্তারা রক্ষা পাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে, একান্ত সাক্ষাৎকারে ঢাকাপ্রকাশকে বিস্তারিত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. আমিন হেলালী।
ঢাকাপ্রকাশ: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মোকাবেলা করতে বাজেটে কোন খাতে বেশি সুবিধা দরকার।
মো. আমিন হেলালী: এফবিসিসিআই’র অন্তর্ভূক্ত ৪২০টি অ্যাসেসিয়েশন (সমিতি) রয়েছে। আরও বিভিন্ন খাতের ২০টি মতো সমিতি রয়েছে। একেকটা পণ্য নিয়ে একেকটা সমিতি। এরমধ্যে ১০০টির মতো জেলা ও ওমেন চেম্বার রয়েছে। সব অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের বিভিন্ন চাহিদা লিখিত আকারে এনবিআর এর কাছে পাঠানো হয়েছে। যেন বাজেট প্রণয়নে ব্যবহার করা হয়। আগামীর বাজেট হবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কারণ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে আমাদের সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। তা মোকাবেলা করতেই বাস্তব সম্মত বাজেট চাই আমরা। বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে এই দাবি করা হয়েছে। সরকারকে তা আমলে নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
ঢাকাপ্রকাশ: পণ্যের দাম কমাতে আপনাদের দাবিগুলো কী?
মো. আমিন হেলালী: পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি তথা তেল, গ্যাস, কৃষি পণ্য গম, ভুট্টা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের রপ্তানি পণ্যের ৬২ শতাংশ পণ্য রম্যাটেরিয়াল (কাঁচামাল) হিসেবে আমদানি করা হয়ে থাকে। আর ৩৮ শতাংশ দেশি চাহিদা মেটায় কাঁচামাল আমদানি করে। এভাবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক ও দেশি সব পণ্যের দাম বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আগে ১০০ টাকার আটা আমদানি করলে ১০ টাকা রাজস্ব পেত। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় একই পণ্য ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা হয়ে গেছে। এতে সরকার রাজস্ব বেশি পাচ্ছে। কিন্তু ভোক্তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এভাবে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এরফলে ভোক্তাদের সব পণ্য বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এটা যাতে না হয় অর্থাৎ ভোক্তাদের উপর যাতে না পড়ে সেদিকে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য সরকার শুল্ক আহরণে শুল্ক সমন্বয় (ডিউটি স্ট্রাকচার) করতে হবে। এতে সরকারের রাজস্ব ঠিক থাকবে বাজারও ঠিক থাকবে। মূল্য খাতেই দাম বেড়েছে। ফ্রেইট ভাড়া ৬০০, ৭০০ ডলার থেকে ৩০০০ ডলার হয়ে গেছে। বিভিন্ন কারণে এই ভাড়া বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে পোর্টে যে সক্ষমতা তার উপর ভাড়া নির্ধারণ হয়। বড় জাহাজ (ফিডার ভ্যাসেল) ভ্যাসেলে আসে বেশি পণ্য। তা মাদার ভ্যাসেলে (বড় জাহাজ ) আসতে পারে না। তাই খরচ বেশি হচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে পৌঁছার জন্য জাহাজ চলে গেছে। বে-টার্মিনাল-১,২ ও ৩ চালু হতে যাচ্ছে। তখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যয় কমবে। মাতারবাড়ি পোর্টও হতে যাচ্ছে। এগুলো চালু হলে দুইভাবে বাংলাদেশ লাভবান হবে। ভারত, নেপাল ও ভুটানও এসব পোর্ট ব্যবহার করবে।
ঢাকাপ্রকাশ: কীভাবে দ্রব্যমূল্য কমতে পারে?
মো. আমিন হেলালী: সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। তবে আসলে বাংলাদেশে ভয়ের কিছু নেই। শঙ্কাও নেই। কারণ বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো না। ২০০৯ সালে তিন বিলিয়ন ডলারের কম রিজার্ভ ছিলো। তা থেকে বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তা থেকে কমে এখনো ৪২ বিলিয়ন ডলার। তাহলে কিভাবে শঙ্কা মনে করব। আমরা কিন্তু কোনভাবেই শ্রীলঙ্কার মতো। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের অর্থনীতিও অনেক শক্তিশালী।
এ ছাড়া আমাদের প্রাইভেট সেক্টরও ভালো অবস্থানে রয়েছে। সরকারের উন্নয়নের মতো উন্নয়নের গতিতে বহবান। তবে সরকারকে কৃচ্ছতাসাধন করতে হবে। কারণ বর্তমানে গ্রামেও বিদেশি ফলে ভরে গেছে। যেহেতু মন্দা চলতে সারা বিশ্বে তাই এ মুহূর্তে সেই সব ফলের আমদানি বন্ধ করতে হবে। দেশি ফলের দিকেই থাকতে হবে। এছাড়া আরও যে সব বিলাসী পণ্য রয়েছে তা আমদানি বন্ধ করতে হবে। সিরিয়াসলি বিভিন্ন কায়দা কানুন করে আমদানি কমাতে সরকারকে নজর দিতে হবে। বিভিন্নভাবে শুল্ক আরোপ করতে হবে।
ঢাকাপ্রকাশ: পণ্যমূল্য কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
মো. আমিন হেলালী: সরকার রেমিট্যান্স আনতে সম্প্রতি যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে ডলারের পরিমান অনেক বেড়ে যাবে। দেশে যেভাবে হোক ডলার আসুক। দেশের ডলারের পরিমান বাড়বে। ক্ষতি নেই। পরে দরকার হলে তালা মেরে দিবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিভিন্ন সার্কুলার জারি করেছে। তা ইতিবাচক। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দামে ডলারের দাম বাজারে রাখতে হবে। বর্তমানে এই দর বাইরে চলে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংকে অনেক বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে। এটা অনৈতিক। এফবিসিসিআই শুধু পলিসি মেকিং সংগঠন। ব্যাংকের রেগুলেটরি বডি (নিয়ন্ত্রক বড়ি) না। ব্যাংকগুলো নিয়ম বা অনিয়মে ডলারের বেচাবিক্রি করছে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাইরে এ ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এফবিসিসিআইএর কোনো কিছু করার নেই।
ঢাকাপ্রকাশ: ব্যবসায়ীরা কেন টাকা পাচার করে?
মো. আমিন হেলালী: টাকা কামানোর (আয়) মাধ্যম ব্যবসা। সবাই টাকা আয় করে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের সহায়তা করে থাকে। ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা লাভ করে। সেই অর্থ বিভিন্ন কাজে লাগায়। তা দেশে বা বিদেশে হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি আমদানি-রপ্তারির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে থাকে তা সরকারি লোকের সহায়তাই করে থাকে। তাদের জোগসাজসেই বিদেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এটা অপরাধ। এ কাজে তারাও জড়িত। ছোট কর্মকর্তারা ইচ্ছা করলেই কিছু করতে পারে না। উপরের জোগসাজসেই তারা করে থাকে। বইয়ের অর্ডার দিয়ে ইলেকট্রনিক্স পণ্য আনলে সেটা হবে অপরাধ (ক্রাইম)। এ ক্ষেত্রে সবার শান্তি হওয়া উটিৎ। উপর ঠিক হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিদর্শককে ধরে লাভ হবে? তার বড়টা ঠিক না হলে। বস ঠিক না হলে পরিদর্শক ঠিক হয়ে লাভ হবে না।
ঢাকাপ্রকাশ: কীভাবে অর্থ পাচার রোধ করা যায়, দেশে আসতে পারে?
মো. আমিন হেলালী: অর্থ পাচার রোধ করতে হলে উপর থেকেই কঠোর হতে হবে। তারা ঠিক হলে দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। অনেকে যেভাবে বলছে যে লাখ লাখ কোটি টাকা অর্থ পাচার হয়েছে তাতে তো দেশ ফকির হয়ে যেত। সরকার বন্ধুত্বপূর্ণ হলে টাকা পাচার হবে না। কেউ আর কালো টাকা রাখবে না। মরলে কাফনের কাপড় পাব এই নিশ্চয়তা থাকলে কেউ বাইরে টাকা বা অর্থ রাখা বর্তমানে কঠিন হয়ে গেছে। তারা সব কিছু জেনেই তারপর অবস্থান করতে দেয়। এক সময়ে সিঙ্গাপুর ফ্রি অ্যাকাউন্ট করতে দিলেও বর্তমানে সেই সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ঢুকলেই জবাব দিতে হয়। মানুষ সুযোগ পেলেই বাইরে যাবে। তবে দেখতে হবে সেটা বৈধ প্রক্রিয়ায় কি না। বৈধ হলে কোনো সমস্যা না। আর অবৈধ হলে যারা সহায়তা করে বা যাদের জোগসাজসে অর্থ পাচার হয় তাদের বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই দেশের অর্থ বাইরে যাবে না।
অনেকে বলে কানাডায় বেগম পাড়ায় বাড়ি বানাচ্ছে, টাকা রাখছে। কেন? এক সময়ে বিদেশে গেলে তারা আমাদের খাওয়াতো। ভালো লাগত। কিন্তু পাল্টে গেছে সেই চিত্র। তাদের অবস্থা দেখলে কষ্ট লাগে। বর্তমানে আমরাই তাদের চেয়ে ভালো আছি। তাদের ভালোর চেয়ে আমরাই বেশি ভালো আছি। মান সম্মান ইজ্জত নিয়ে বেঁচে আছি। বুক ফুলিয়ে হাটতেছি।
ঢাকাপ্রকাশ: কালো টাকা বাড়ছেই, বাজেটে সাদা করার ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
মো. আমিন হেলালী: কোনো কালো টাকা হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচি নয় সরকারের। যেভাবেই হোক বৈধ পন্থায় টাকা খরচ করার সুযোগ দিতে হবে। আমি অর্থনীতি ভালো না বুঝলেও কোনো টাকাই কালো টাকা হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না সরকারের। টাকা সাদা থাকবে। তা চলতে থাকবে। কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ তা নীতির মধ্যে ধরা হয়। ভয়ভীতি দেখিয়ে হবে না। সব কিছু কমপ্লায়েন্স থাকলে টাকা কালো হবে না। সরকার অনেক নীতি করতে পারে।
সরকার কালো টাকা সাদা করতে বিভিন্ন আইন ও নীতি করে থাকে। ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করেন। তাহলে টাকা কালো হবে কেন? ব্যবসায়ীরাও মানুষ। কাজেই আমি একজন মানুষ বা জনগণ হিসেবে বলব, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকা ঠিক না। কোনো সুযোগই দেওয়া ঠিক না। যে কোনো উপায়ে হোক সাদার মধ্যেই থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ একটা ইট গাথলেও দেশের টাকা দেশে থাকবে। দেশেই অর্থ খরচ করার সুযোগ দিতে হবে। এর উপকার দেশের মানুষই পাবে। খরচ করা মাত্রই হিসাব করতে শুরু করলে অর্থাৎ ধরতে থাকলে চলবে না।
জেডএ/