সংখ্যা নয়, ঐক্যমতে হবে জাতীয় ঐক্য
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে চূড়ান্ত পথে টেনে নিতে রূপরেখা তৈরি করতে যাচ্ছে বিএনপি। সেই লক্ষে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ শুরু করেছে দলটি।
এখনই জোটবদ্ধ নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের চিন্তাভাবনা ও দাবির বিষয়ে প্রাথমিকভাবে একটি খসড়া তৈরিতে মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে এ সংলাপের যাত্রা শুরু করে বিএনপি।
ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ এমন রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া এই মুহূর্তে সরকারবিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যুক্ত থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনার দরজা খোলা রাখার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব বিএনপির। দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক আলোচনায় বিএনপির মূল যে দাবিগুলো আছে, প্রথম: দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সমস্ত রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি, দুই: বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকা্রকে পদত্যাগ করতে হবে, পদত্যাগ করে তাদের নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, তিন: সংসদ বাতিল করতে হবে এবং তারপরে পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ গঠন হবে, সরকার গঠন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কিছু নেই। আমাদের দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। সবে মাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার দ্বার উন্মুখ হয়েছে। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা কিন্তু সব সময়ই হচ্ছে। দাবি আদায়ে এই সরকারের বিরুদ্ধে যে সব রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যেমতে পৌঁছাবে তাদের নিয়ে এক পথে এক সঙ্গে হাটঁতে শুরু করা হবে। যদিও চলার পথে অনেক ষড়যন্ত্র হবে, কেউ কেউ লোভে পড়ে যাত্রা বিরতিতে যাবে, কেউ আবার ঐক্যে ভাঙার দালালিতে জড়িয়ে পড়বে। কাজেই জাতীয় ঐক্যে গঠনে সংখ্যা বিষয় নয়, দেখার বিষয় শেষ পর্যন্ত কারা থাকবে। তখন আমরা যারা একসঙ্গে থাকব তারাদের সবাইকে নিয়ে সরকার গঠন করা হবে। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে জাতীয় সরকারের কথা বলেছেন- সেই সরকার গঠন করা হবে। অবশ্য সেই পর্যন্ত সবাইকে ঐক্যে ধরে রাখতে হবে।’
এদিকে, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে এবং নির্বাচন প্রতিহত করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। পরবর্তীতে ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফন্ট্রের ব্যানারে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। সেই নির্বাচনে ভরাডুবির পরাজয় বরণ করার পরও নির্দলীয় সরকারের দাবি থেকে সরে আসেনি বিএনপির অবস্থান। বরং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্দোলন সংগ্রামে পাশে রাখতে দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব জাতীয় সরকার গঠন সেই বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডের। যদিও বিএনপির ঘোষিত জাতীয় সরকার ব্যবস্থা ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ঘোষিত জাতীয় সরকার ব্যবস্থার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। বিএনপি চাচ্ছে এই সরকারের পতন নিশ্চিত করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। পরবর্তীতে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। কিন্তু অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে কোনো দল চাচ্ছে এক সঙ্গে আন্দোলনে যাওয়ার পূর্বেই জাতীয় সরকার গঠন ব্যবস্থার ধরণ নির্ধারণ করা। অবশ্য জাতীয় সরকার গঠনে ভিন্নমতকে মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে অপরের আস্থাহীনতা-অবিশ্বাস থেকে সৃষ্টি বলেই ধরে নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। সেই ধারাবাহিকতায় জাতীয় সরকার গঠনের চেয়ে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে সরকার পতনে সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে উঠে আসা ঐক্যমতের ভিত্তিতে আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—দলীয় সরকারের অধীন বিশেষ করে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলব। সেই প্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের যে রূপরেখা, সেই রূপরেখা তৈরি করা হবে। সেক্ষেত্রে জোটে থাকা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও কথা বলতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা না বললে কেমন হবে। সবার সঙ্গেই হবে, অল দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস।
তিনি বলেন, আলোচনার মূল্য উদ্দেশ্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং এই ফ্যাসিবাদী সরকার যারা মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়েছে, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে এবং আজকে অর্থনীতি, দেশের সমস্ত যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলোকে ধবংস করে ফেলেছে সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা—এটাই হচ্ছে আমাদের মূল্য লক্ষ্যে। এজন্য আন্দোলন তৈরি করতে হবে। এই আন্দোলন তৈরি করতে ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে এই আলোচনার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি।
বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা সরকারবিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত বিএনপির। সেক্ষেত্রে আলোচনার প্রাথমিক তালিকায় রয়েছে নাগরিক ঐক্যে, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), গণ অধিকার পরিষদ, গণফোরাম (ড. কামাল), গণফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বিবেচনায় রাখা হচ্ছে—বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু), জাতীয় পার্টিকে (এরশাদ), গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টির প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তবে এখানেই চূড়ান্ত নয়। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় সংলাপ আলোচনায় ব্যক্তি ও দলের পরিবর্তন হতে পারে বলেও জানা গেছে।
নামপ্রকাশে অনিইচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ঢাকাপ্রকাশ কে বলেন, জাতীয় ঐক্যে গড়ে তোলা এতো সহজ বিষয় নয়। এটি গড়ে তুলতে অনেক প্রতিবন্ধকতা বিবেচনায় ধীরে চলা নীতি অবলম্বন করা হলে অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফল আসবে। এখানে তড়িঘড়ির কিছু নেই। এটাই হবে সরকারবিরোধী সবশেষ পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছাকে মূল্যায়ন জানাতে গিয়ে জাতীয় ঐক্যে গঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, বিএনপি জাতীয় ঐক্যের কথা সভা-সমাবেশ-সেমিনারে বলছেন অথচ কোনো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তেমনভাবে আসেন না। তাদের সেই কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিকভাবে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। সময় যত যাবে আলোচনায় ঐক্যেমতে হওয়া তত সম্ভবপর হয়ে উঠবে।
এমএইচ/আরএ/