প্রতারক চক্রের হাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ডিভাইস
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে থাকা ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর চেয়েও ক্ষমতা সম্পন্ন ডিভাইস এখন প্রতারক চক্রের হাতে। আমদানি নিষিদ্ধ হলেও একটি চক্র অন্য পণ্যের আড়ালে এগুলো দেশে এনে তুলে দিচ্ছে এই চক্রের হাতে। ডিভাইসগুলো নিয়ে চক্রটি নানা ধরনের প্রতারণা ও অসৎ উদ্দেশে ব্যবহার করছে। অতি সম্প্রতি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জ্যামার, বুস্টার, হিডেন স্পাই ওয়ারলেস কিট ও ওয়াকিটকি জব্দ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলো সাধারণ মানুষের হাতে থাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোর অপব্যবহারের যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে। অনেকেই আবার এগুলো অপরাধমূলক কাজেও ব্যবহার করছেন।
গত ১৪ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ জ্যামার, রিপিটার ও নেটওয়ার্ক বুস্টারসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গ্রেপ্তাররা হলেন- মো. আবু নোমান ও সোহেল রানা। তাদের কাছ থেকে চারটি মোবাইল নেটওয়ার্ক জ্যামার, ২৪টি জ্যামার এন্টিনা, চারটি এসি এডাপ্টার, তিনটি পাওয়ার ক্যাবল, তিনটি মোবাইল নেটওয়ার্ক বুস্টার, নয়টি বুস্টারের আউটডোর এন্টিনা, ২৬টি ইনডোর এন্টিনা, ৩৭টি বুস্টারের ক্যাবল, একটি ল্যাপটপ জব্দ করে। বিষয়টি নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনও করে।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, অবৈধ জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টার বিক্রয়কারী চক্রের কিছু সদস্য দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় বিনা অনুমতিতে অবৈধ জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টার বিক্রয় করে আসছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাবের একটি দল বিটিআরসির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গত শনিবার রাত পৌনে ১টায় মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টার বিক্রয়কারী ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা র্যাবকে জানিয়েছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টার বিক্রি করে আসছেন। গ্রেপ্তার নোমানের ‘আইটি স্টল.কম.বিডি’ নামে ই-কমার্স ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ রয়েছে। সোহেল রানার ‘সোআইএমবিডি’ নামে ই-কমার্স ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ রয়েছে।
র্যাব জানিয়েছে, ই-কমার্স ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজের মাধ্যমে গ্রেপ্তাররা আইপি ক্যামেরা, ডিজিটাল ক্যামেরা ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের পাশাপাশি উচ্চমূল্যে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টারসহ এর যন্ত্রাংশ লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে বিক্রি করে থাকে।
র্যাব অধিনায়ক জানান, জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টার টুজি, থ্রিজি এবং ফোরজি মোবাইল নেটওয়ার্কের কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। তাদের ক্রেতা বিভিন্ন বহুতল ভবনের বাসিন্দা, মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও বিভিন্ন অপরাধীরা অপরাধ করার উদ্দেশে উচ্চমূল্যে এসব অবৈধ ডিভাইস কিনে থাকে।
বিক্রি ও আমদানি নিষিদ্ধ এসব পণ্য কিভাবে দেশে আসছে জানতে চাইলে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, বৈধ আমদানিকারকদের মাধ্যমে অধিক পরিবহন মূল্য পরিশোধ করে বৈধ মালামালের আড়ালে তারা এসব অবৈধ যন্ত্রাংশ আমদানি করছে। এরপর চাহিদা মোতাবেক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে আসছিল।
তাদের নাশকতার পরিকল্পনা ছিল কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তর পায়নি র্যাব। যেহেতু উত্তর পায়নি, সে কারণে র্যাব ধারণা করছে, অবশ্যই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পনা ছিল, সঙ্গে নাশকতার ষড়যন্ত্রও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশের স্থিতিশীল পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এসব অবৈধ জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টার বিক্রি করা হচ্ছিল বলেও জানান লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন।
তিনি বলেন, এর পাশাপাশি অধিক মুনাফা লাভের আশায় তারা এসব বিক্রি করে আসছিল। এছাড়াও আরও জিজ্ঞাসাবাদেও সময় পেলে আরও তথ্য পাওয়া যাবে।
কারা কিনতেন জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টার, কাদের কাছে এসব অবৈধ ডিভাইস বিক্রি করা হয়েছে জানতে চাইলে লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দুই বছরে দুই শতাধিক জ্যামার ও নেটওয়ার্ক বুস্টার বিক্রি করা হয়েছে। আমরা বিস্তারিত তালিকা পাইনি। তবে বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা জেনেছি। তথ্য প্রমাণ নিশ্চিত হওয়ার পর খুব শিগগির অভিযান চালানো হবে।
এর একদিনই পরেই হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট জব্দ করে র্যাব। এটি ব্যবহার করে সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে চাকুরী প্রার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলেও জানায় র্যাব।
এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় ইকবাল হোসেন (৪২), রমিজ মৃধা (৩০), নজরুল ইসলাম (৫০) এবং মো. মোদাচ্ছের হোসেন (৬২)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা বর্ণিত প্রতারণা সম্পর্কে নিজেদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য দেন।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, প্রথমে তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ওই নিয়োগ পরীক্ষার পরীক্ষা নেওয়ার স্থান ও পরীক্ষার গার্ড সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে। এসময় চক্রের অন্যান্য সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি/বেসরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে ১০-১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাশ ও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তার মাধ্যমে তাদের প্রলোভন দেখাত। পরবর্তীতে আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের কাছে উদ্ধারকৃত ডিজিটাল ডিভাইসগুলো প্রদান করে এর ব্যবহার বিধি প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাথমিকভাবে ১/২ দুই লাখ টাকা জামানত হিসেবে গ্রহণ করত। অবশিষ্ট টাকা চাকরি পাওয়ার পরে পরিশোধ করবে মর্মে চুক্তি করত। এভাবে তারা বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
গ্রেপ্তাররা জিজ্ঞাসাবাদে তাদের প্রতারণার কৌশল হিসেবে আরও জানান যে, বিদেশ থেকে আনা এই ডিজিটাল ডিভাইসগুলো মূলত দুইটি অংশে বিভক্ত। ডিভাইসটির একটি অংশ ইয়ার পিছ তারা পরীক্ষার্থীদের কানের ভেতর এবং অটোমেটিক কল রিসিভ হওয়া সীম লাগানো অপর অংশটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে তাদের পরীক্ষার হলে প্রবেশ করাত। পরবর্তীতে পরীক্ষার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের নিকট পাঠাত। প্রতারক চক্রটি প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়ার জন্য পূর্ব থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি টিম প্রস্তুত রাখত। অতঃপর এই চক্রের সদস্যরা পরীক্ষার হল থেকে পাঠানো প্রশ্নপত্রের উত্তরগুলো মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত টিম এর মাধ্যমে খুঁজে বের করে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের বলে দিত।
এদিকে গতকাল সোমবার বিপুল পরিমান ওয়াকিটকি জব্দের তথ্য জানায় র্যাব। এ ওয়াকিটকিগুলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে থাকা ওয়াটকির চেয়েও তিন চারগুন ক্ষমতাসম্পন্ন।
জানা যায়, কয়েক বছর আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টম হাউজের প্রিভেনটিভ দল ১৭টি চালানে প্রায় এক হাজার ওয়াকিটকি জব্দ করেছে। জব্দকৃত এ সব ওয়াটকির এখন পর্যন্ত কেউ মালিকানা দাবি করেনি। তবে যে ঠিকানা ব্যবহার করে সেটগুলো শাহজালালে আসে সেই নাম ঠিকানাও ভুয়া।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয় দিয়ে অপরাধ ও বাহিনীর সেট টিউনিং করে কথোপকথন শোনে অবস্থান শনাক্তের জন্যই এই সেটগুলো আমদানি করছে একটি চক্র বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র মতে, রাজধানীসহ সারাদেশে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তারও হচ্ছে এ সব অপরাধীরা। এসময় তাদের কাছ থেকে পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহৃত ওয়াকিটকি সেটও উদ্ধার হচ্ছে।
জানা যায়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে বিশেষ করে ছিনতাইয়ের সময় অপরাধীদের হাতে ওয়াটকি সেট দেখা যায়। ওয়াটকি হাতে থাকেল সহজেই সেই ব্যক্তিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে ধারনা করেন সাধারণ মানুষ। বাইরে সাধারণ ওয়াকিটকি কিনতে পাওয়া গেলেও জব্দ করা ওয়াটকি সেট উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন। এর রেঞ্জ ক্ষমতাও অনেক।
বিমানবন্দরে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক এক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, জব্দ হওয়া ওয়াকিটকি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন। দেশের কয়েক গোয়েন্দা সদস্যরা যে ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার করেন তার ক্ষমতা ঢাকা, নারায়নগঞ্জ এবং গাজিপুর। ঠিক এই সেটগুলোর ক্ষমতাও একই।
এদিকে শুধু ওয়াকিটকিই নয় ঝুঁকিপূর্ণ এসকল সাধারণ ব্যক্তিদের জন্য আমাদানি নিষিদ্ধ এ সকল ঝুঁকিপূর্ণ ডিভাইসগুলো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আনা হচ্ছে। বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে ডিভাইসগুলো আমদানি করা হয়ে থাকে।
কাস্টম প্রিভেনটিভের উপ-কমিশনার সানোয়ারুল কবির বলেন, আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যাপারে আমরা বরাবর সতর্ক থাকি। এর মধ্যেও অন্য পণ্যের আড়ালে কেউ আমদানি করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমরা সচেষ্ট থাকব।
কেএম/আরএ/